196519

আড়াই লক্ষ কোটির বিলাসিতার সম্পদ ছেড়ে ঘাম ঝরাচ্ছে ক্রিকেটে

স্পোর্টস ডেস্ক : বাদশাহি মেজাজ? উঁ হুঁ, মিলল না। রাজসিক বিলাসিতা? তা তো আছেই। যার বাবার নাম কুমার মঙ্গলম বিড়লা, যাদের মোট সম্পত্তির মূল্য ২ লক্ষ ৬০ হাজার ৮৩৪ কোটি রুপি (সংখ্যায় লিখলে টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় এ রকম ২,৬০,৮৩৪,০০০০০০০)।

সেই বাড়ির ছেলে চাইলে প্রতিদিন প্যারিসে ব্রেকফাস্ট করে মুম্বাইয়ের বাড়িতে এসে ডিনার করতে পারেন। চাইলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে দিব্যি ব্যবসা করতে পারেন। তা না করে, বিড়লা বাড়ির ২০ বছর বয়সী আর্যমান বিড়লা রোদের তাপে ঘাম ঝরিয়ে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখছেন!

দেশের হয়ে ক্রিকেট! চাইলেই কি পাওয়া যায়? এ জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠা দরকার প্রতিভা বিচ্ছুরণ ঘটানোর জন্য, তা কিন্তু পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। তা হলে, ঘরে ঘরে গাভাস্কার, বিশ্বনাথ, কপিলদেব, টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়, গাঙ্গুলিদের দেখা যেত। সময় দিতে হয়, আলস্য ত্যাগ করে ব্যাট-বল নিয়ে পড়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

চরম বিলাসিতা যেখানে রয়েছে তালুর মধ্যে, সে সব ছেড়েছুঁড়ে আশ্রমিক ব্যাপার-স্যাপারে মন দেওয়া সম্ভব? সম্ভোগে থাকার যে হাতছানি প্রতি সেকেন্ডে রয়েছে, সেখান থেকে নিজেকে একমুখী (পড়তে হবে, ক্রিকেটমুখী) করে ফেলা সহজ ব্যাপার নয়। আর্যমান কিন্তু এমন সুলভ হাতছানি ছেড়ে ব্যাট-বলের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে আত্মত্যাগের দুনিয়ায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চাইছেন।

জায়গা হয়নি মুম্বাই ক্রিকেট মহলে। তাই তাকে চলে যেতে হয়ে উত্তর-পূর্ব মধ্যপ্রদেশের রেওয়া নামে এক অখ্যাত শহরে। সেখান থেকে তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলে মধ্যপ্রদেশের অনূর্ধ্ব ২৩ বিভাগের অধিনায়ত্বের দায়িত্ব পালন করছেন। এ মরশুমে দুটি সেঞ্চুরি-সহ রান করেছেন ৬০২। এর মধ্যে ছত্তিশগড়ের বিপক্ষে ২৩৬ রানের ইনিংসটি নির্বাচকদের নজর কেড়ে নিয়েছে।

এ জন্যই আসন্ন আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের কর্তারা আর্যমানকে ডেকে নিয়েছেন। রাজস্থান রয়্যালসের কর্তা মনোজ বাদালে জয়পুর থেকে টেলিফোনে বললেন, ‘আমাদের ক্রিকেটের ব্যাপার-স্যাপার দেখাশোনা করে জুবিন বারুচা। ওর পরামর্শেই আমরা আর্যমানকে নিয়েছি।’
৩০ লক্ষ টাকা চুক্তিতে আর্যমান এবার আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের জার্সি গায়ে দেবেন। নিজেদের সম্পত্তির মোট যা অঙ্ক, তা মাথায় রাখলে ৩০ লক্ষ টাকা এমন কিছুই নয়, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে এই প্রথম তাঁর রোজগারের চেক ধনী পরিবারে ঢুকবে!

সেসব নিয়ে অবশ্য মোটেই চিন্তিত নন এই প্রতিবেদনের নায়ক। জিমনাসিয়ামে সময় কাটানোর পর্ব শেষ করেই টেলিফোনে মুম্বইয়ে নিজের বাড়ি থেকে বললেন, ‘বাড়িতে কেউ ক্রিকেট খেলেনি ঠিকই, কিন্তু আমাকে সমান তালে উত্‍সাহ, উদ্দীপনা দিয়ে আসছে আমার বাবা, মা। ফুটবল, টেনিস, হকি সব খেলেছি। কিন্তু এখন শুধুই ক্রিকেট।’ বি. কম পড়ছেন।

কিন্তু মন পড়ে থাকে ক্রিকেট মাঠে, ‘পড়াশোনা এবং ক্রিকেট, এই ব্যালান্সটা মেইনটেইন করা কঠিন। কিন্তু এটাই চ্যালেঞ্জ। আমি জানি আমার মাথাকে নিচে রাখতে হবে। পা রাখতে হবে মাটিতে। জাতীয় ক্রিকেটার হওয়ার জন্য এই দুটো ব্যাপার অনুসরণ করে আসছি। বাবা, মা বলে দিয়েছেন, এই দুটো ব্যাপারে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে।’

তেমন ভাবে কোনও আদর্শ ক্রিকেটার নেই তার। অনেক ছোটবেলায় শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আর্যমান নিশ্চিত নন যে, হঠাত্‍ রাস্তায় দেখা হলে শচীন তাকে চিনতে পারবেন।

কেমন ক্রিকেটার আর্যমান?

বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান, বাঁহাতি স্পিনার। অলরাউন্ডার। গত মরশুমে অনূর্ধ্ব ২৩ বিভাগে ১০ উইকেট পেয়েছিলেন। অজিঙ্ক রাহানের কোচ প্রবীণ আমরের কাছেই নিজের ক্রিকেটের প্রাথমিক পাঠ নিতে শুরু করেছেন সবে চার বছর আগে। কতদূর এগোতে পারবেন, আর্যমান?

মুম্বাই থেকে আমরে জানালেন, ‘মায়ের হাত ধরে প্রথম দিন শিবাজি পার্কে আমার শিবিরে এসেছিল। ওকে দেখে মনে হয়েছিল, চেষ্টা করলে পারবে। বিড়লা বাড়ির ছেলে বলে শিবিরে জায়গা দিইনি। আইপিএলে সুযোগ পেয়েছে। আমি একেবারেই উত্তেজিত নই। উত্তেজিত হওয়ার ব্যাপারটা আসে যখন কোনও শিক্ষার্থী দেশের হয়ে খেলার ডাক পায়।’

কোচ যা-ই বলুন না কেন, তরুণ আর্যমান কিন্তু যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে আছেন, ‘আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলবে স্টিভ স্মিথ, বেন স্টোকস, অজিঙ্ক রাহানের মতো ক্রিকেটাররা। এখন আমার শেখার সময়। আইপিএল চলার সময় এমন বিখ্যাত ক্রিকেটারদের কাছ থেকে শুধুই শিখতে চাইব।’

মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান কর্তা, প্রাক্তন ক্রিকেটার ও জাতীয় নির্বাচক সঞ্জয় জাগদালে জানালেন, ‘সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে এবং ড্রেসিংরুমে একবারের জন্য বুঝতে দেয় না, ওর পারিবারিক পরিচয়। খুবই বিনয়ী। আন্তরিকভাবে ভাল খেলার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় কথা ক্রিকেট-বুদ্ধি থাকায় খুব তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর করছে।’

মধ্যপ্রদেশের হয়ে যেদিন প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, সেদিন মাঠে এসেছিলেন ওঁর বাবা ও মা। জাগদালে জানাচ্ছেন, কাউকে বুঝতেই দেননি ওঁরা খেলা দেখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা জরুরি। ইতিমধ্যেই বিড়লা পরিবার বুঝে নিয়েছে ক্রিকেট মাঠের সঙ্গে ধনী বা গরিবদের কোনও সম্পর্ক নেই। ক্রিকেট মাঠের সংস্কৃতি অনুসরণ করুক তাঁদের পরিবারের ছেলে, এটাই যেন হাবেভাবে আর্যমানের বাবা-মা ছেলেকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

মধ্যপ্রদেশের অন্যতম নির্বাচক ব্রিজেশ তোমার ইন্দোর থেকে টেলিফোনে বললেন, ‘খুবই বিনয়ী, আমরা দেখেছি, নেটে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেকে ঘষামাজা করে চলেছে। অবাক হব, যদি আর্যমান অদূর ভবিষ্যতে ইন্ডিয়া টিমে চান্স না পায়।’

এখানেই ক্রিকেট খেলার মহিমা। জনপ্রিয়তাও বটে। কুমার মঙ্গলম বিড়লার চেয়ে জনতার মনে সুনীল গাভাসকার, শচীন তেন্ডুলকাররা যে অনেক বড় জায়গা নিয়ে রয়েছেন, তা উপলব্ধি করেই সম্ভবত আর্যমান ক্রিকেট খেলার দিকে ঝুঁকেছেন। কাজটা কঠিন। কাজটা শৃঙ্খলার। প্রত্যয়েরও বটে।

ইতিমধ্যেই আর্যমান যে তা অনুভব করেছেন, এটা বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার সময়েই টের পাওয়া গেল। এত ধনী পরিবারের সন্তানের জন্য আমরা কী-ই বা করতে পারি, শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া।

ad

পাঠকের মতামত