অকৃতজ্ঞ কেকেআর!
স্পোর্টস ডেস্ক: ভগ্নাংশতম আশাও যদি কেউ করে থাকে, মুহূর্তেই তা উবে গেল। সাকিব আল হাসানের পরনে অনুশীলনের জার্সি। সিলিংয়ে ঝোলা বাঁ হাত প্লাস্টারে বাঁধা। সেই বাঁ হাত, দ্য গোল্ডেন আর্ম আজ সত্যিকার আর জাদু দেখাতে পারল না। সাকিবের চোখমুখে রাজ্যের হতাশা। ছবিটা নিশ্চিত করে দিল, সাকিবের ব্যাট হাতে নামার কোনো সম্ভাবনা নেই!
এই ত্রিদেশীয় সিরিজ সাকিব আর বাংলাদেশকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে। কী উজ্জ্বল শুরু, কী আঁধারে শেষ! টানা তিন ম্যাচে তিন উইকেট নিয়েছেন, প্রতি ম্যাচে হেসেছে ব্যাট। শেষ দুই ম্যাচে ব্যাট হাসেনি। গত দুই ম্যাচে তো বল করলেনই ৬ ওভার!
চোটে তিনি পড়েই কালেভদ্রে। আর সাকিবের হাতে প্লাস্টার আগে ক্রিকেট মহলে কেউ দেখেছে কি না, সেটা স্মৃতি হাতড়েও বলা গেল না।
সাকিবের জন্য আজকের দিনটাই অদ্ভুত এক দিন। ম্যাচের টস আর সাকিবের আইপিএল নিলাম প্রায় একই সময়ে হয়েছে। নিজের দ্বিতীয় ঘর হয়ে ওঠা কলকাতা নাইট রাইডার্সে আর থাকা হচ্ছে না, মাঠে নামার আগেই হয়তো জেনেছেন। পেশাদার যুগে আবেগ নাকি বড্ড খেলো। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তো ব্যাটে-বলের করপোরেট দুনিয়া। তবু একটুও কি খারাপ লাগেনি সাকিবের?
আধঘণ্টার ফ্লাইটে উড়াল দিলেই যে শহর। চ আর ছ-য়ের টানে খানিক পার্থক্য আর ক্রিয়াপদে উ-কার ব্যবহারের ঝোঁক বাদ দিলে ভাষা তো প্রায় একই। খাবার-দাবার সংস্কৃতিও প্রায় এক। সাহিত্য আর গানের পাশাপাশি দুই বাংলার যোগসূত্রও হয়ে উঠেছিলেন সাকিব।
সেই শহর ছেড়ে এবারে অন্য শহরে। ১৮ শ কিলোমিটারের চেয়েও দূরত্ব আসলে অনেক গুণ বেশি। সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণেই। হৃদয়ের টানের কারণেই।
এ হয়তো সত্যি, ক্রিকেটে ক্লাব ফুটবলের স্বাদ এনে দেওয়া এই লিগগুলোতে খেললে ঠিকানা বদলাবেই। আগের দিন লিভারপুলে তো পরের দিন বার্সেলোনায়। আবার বার্সেলোনায় বাক্সপেটরা গুছিয়ে কেউ প্যারিসে যায় তো কেউ চীনে।
হাভিয়ের মাসচেরানোর কথা মনে পড়ছে আরেকটি কারণে। সাকিবের কেকেআরে আর মাসচেরানোর বার্সায় যোগ দেওয়া মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। দুজনেরই শেষের দিকে দলে জায়গা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। দুজনেরই ঠিকানা বদল হলো কাছাকাছি সময়ে।
সা-ত বছর বার্সাকে ‘সার্ভিস’ দেওয়ায় পরশু কী অভ্যর্থনাটাই না পেলেন মাসচেরানো! সমর্থকেরা পারলে কাঁদিয়ে ছাড়ে। অথচ কেকেআর থেকে সাকিবের বিদায়টা হলো একদম নীরব। মাঠে খেলে বিদায় দেওয়ার সুযোগ কেকেআরের ছিল না। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে সাকিবকে ধন্যবাদটুকুও তারা জানায়নি। না, সাকিবকে কেকেআর দলে প্রয়োজন নাও মনে করতে পারে। এতে একটুও দোষ নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। অন্তত দুটি শব্দে হলেও।
এবার আইপিএলে প্রায় সবগুলো দলেই বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো একগাদা খেলোয়াড়কে কেউ ধরে রাখতে পারেনি বলে। কেকেআর যেমন তাদের অধিনায়ক গৌতম গম্ভীরকেই রাখেনি। তবে কেকেআর তাঁর উদ্দেশে বিদায়ী বার্তা দিয়েছে। টুইট করে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে, ভিডিওবার্তায়।
অথচ এক সময় আইপিএলের বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি দলের একমাত্র বাঙালি খেলোয়াড় হয়ে গিয়েছিলেন যিনি, দলের একাদশে করব লড়ব জিতব রে একমাত্র যিনি পুরো শুদ্ধ ভাষায় উচ্চারণ করতে পারবেন, সেই সাকিব কোথাও নেই!
অথচ সাকিব কেকেআরের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ১০ খেলোয়াড়ের একজন। আরও স্পষ্ট করে বললে, কেকেআরের হয় সাত মৌসুম খেলেছেন এমন খেলোয়াড় সাকিব ছাড়া আছেনই আর দুজন, গম্ভীর ও ইউসুফ পাঠান। পাঠানকেও ধন্যবাদ তারা জানিয়েছে কৃপণ টুইটে হলেও। কিন্তু সাকিবের নামটাই যেন ভুলে গেছে তারা!
কেকেআরে কে কে আসছে তা নিয়েও মূলত ব্যস্ত ছিল তাদের সামাজিক মাধ্যমের পাতাগুলো। এর মধ্যে কে কে বিদায় নিচ্ছে সেটিও উল্লেখ করছিল। কিন্তু তাদের টুইটার কি ফেসবুক পাতা, কোথায় সাকিবকে নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করা নেই!
অথচ বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সির পর গাঢ় বেগুনির ওপর সোনালি আভার জার্সিতে সাকিব সবচেয়ে চেনামুখ ছিলেন। ২০১১ সালের পর এ সাকিবকে কলকাতা নিলামের হাতুড়ির নিচে যেতে দেয়নি। আগেই রেখে দিয়েছিল। সেই সাকিবকে সামান্য বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো হয়তো অনেকের কাছে সামান্য ব্যাপার।
সাকিবের কারণে বাংলাদেশেও বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী জুটে গিয়েছিল কেকেআরের। এবার হায়দরাবাদের সমর্থক নিশ্চয়ই আরও বাড়বে। নতুন দলে নতুন চ্যালেঞ্জ সাকিব হাসিমুখেই নেবেন। তবে কেকেআরের এই নিস্পৃহতা হয়তো কষ্ট দেবে, হয়তো দেবে না। ভাবালুতায় ভোগার মানুষ তিনি নন। কিন্তু সা-ত বছর, কম সময় তো নয়!
আজ রাত ৮টা পর্যন্ত কেকেআরের ওয়েবসাইট, টুইটার ও ফেসবুক পেজে গিয়ে বিদায়ী বার্তার দেখা মিলল না। সর্বশেষ পোস্ট পাওয়া গেল, কেকেআর নিলামে কত খরচ করেছে, কত রইল বাকি। টাকাটাই যে এখানে সব! কিন্তু ধন্যবাদ যারা জানায় না তাকে কি অকৃতজ্ঞ বলা যায়? বাংলা ভাষার অভিধান ওই বাংলাতেও আছে নিশ্চয়ই!
এমটি নিউজ