195141

মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে ফিরে আসা

জিম পোলেহিনক ছিলেন কমএয়ার বিমান সংস্থার কো-পাইলট। ২০০৬ সালের ২৭ আগস্ট ৫০ জন যাত্রী নিয়ে তাদের বিমানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের লেক্সিংটন থেকে আটলান্টা যাচ্ছিল। ওড়ার পরপরই পাইলটের ভুলে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। সব আরোহী নিহত হন, বেঁচে যান শুধু জিম পোলেহিনক। তার জবানিতে সেই স্মৃতি-

বিমানটিকে পাইলট যখন টার্মিনাল থেকে রানওয়েতে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমি ইকুইপমেন্ট সেটিংসের প্রি-ফ্লাইট চেকলিস্ট দেখায় ব্যস্ত ছিলাম। এ কারণে জানালা দিয়ে রানওয়ে নম্বরটি দেখার কথা মনে আসেনি। অথচ এ কাজটি আমি প্রায় সবসময়ই করে থাকি।

অথবা হতে পারে, আমি তাকিয়েছিলাম কিন্তু লক্ষ করিনি আমরা- যে রানওয়েতে যাওয়ার কথা ট্যাক্সিওয়ের দু’পাশের মার্কারগুলো তার সঙ্গে মিলছে না। এই লক্ষ না করাটা এ কারণে হতে পারে, বিমানবন্দরের অনেকগুলো লাইটই ছিল নষ্ট।

আমরা ওড়ার অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম। একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এবার যেতে পারি।’ বিমান চলতে শুরু করল। তিনি একটি বাঁক নিয়ে আবার সোজা চালাতে শুরু করলেন। আমাকে বললেন, ‘ইওর ব্রেক, ইওর কন্ট্রোল’। আমি বললাম, ‘মাই ব্রেক, মাই কন্ট্রোল’।

এর পর কী ঘটেছিল, মনে পড়ে না। পরে ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে আমার কণ্ঠস্বর শুনেছি, ‘ওখানে অন্ধকার, আলো নেই।’ এর একটু পরই আমাদের বিমান একটি বেড়িবাঁধে আঘাত করে। তারপর লাফিয়ে ওঠে। তারপর বিমানবন্দরের বেড়া ও কয়েকটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং কয়েক টুকরো হয়ে যায়।

দ্রুত উদ্ধারকারী দল আসেন। তারা ধ্বংসস্তূপের ভেতর আমার কাশির শব্দ শুনে সেখান থেকে আমাকে বের করে আনেন। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের গাড়িতেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালে আমি চারদিন অচেতন (কোমা) অবস্থায় থাকি। শরীরটা হয়ে গিয়েছিল যেন একটি ভাঙাচোরা পুতুল। হাত-পা ভেঙে যাওয়া ছাড়াও ডান ফুসফুসটি অচল হয়ে গিয়েছিল আর হয়েছিল ব্রেন ইনজুরি।

চারদিনের মাথায় ডাক্তাররা আমাকে কোমা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হন। তারা অপেক্ষা করতে থাকেন আমার হুঁশ ফেরার জন্য। এসময় আমার স্ত্রীও সেখানে ছিলেন। আমি ভাবতে থাকি, আচ্ছা, আমি তাহলে হাসপাতালে! কিন্তু কী হয়েছিল? পরে আমার স্ত্রী আমাকে বিমান দুর্ঘটনার কথা জানান। আমি জানতে চাই, ‘অন্য সবাই ভালো আছে তো?’ তিনি বলেন, ‘না, শুধু তুমিই বেঁচে আছ।’ শুনে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।

প্রথম সপ্তাহে ডাক্তাররা আমার বাম পা বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অবশেষে একদিন একজন ডাক্তার এসে আমাকে বলেন, ‘দেখুন, আমাদের সামনে দুটি কাজ। এর একটিকে বেছে নিতে হবে। আমরা আপনার এই পা-টি রেখে দিতে পারি। কিন্তু পরে এর সংক্রমণজনিত কারণে আপনি মারাও যেতে পারেন। বিকল্প হচ্ছে, এই পা কেটে বাদ দেয়া।’

তা-ই হল। ডাক্তাররা আমার বাম পা কেটে বাদ দিলেন। এরপর আমি দ্রুত সেরে উঠতে থাকলাম।

এই ঘটনার পরের কয়েকটি বছর আমি মানসিকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় ছিলাম। সব দোষ পাইলট ও আমার ওপর চাপানো হচ্ছে জানলে আমার খুব রাগ হতো। নিহত আরোহীদের স্বজনদের কথা ভেবেও খুব কষ্ট পেতাম। আমি নিজেকে বলতাম, বেঁচে আছি বলে আমার কি খুব খুশি হওয়া উচিত?

এই কঠিন দিনগুলোতে আমার পাশে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন আমার স্ত্রী আইডা। আমি তার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে ভরসা দিয়েছেন, যত্ন নিয়েছেন। এমন স্ত্রী পেয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান।

এখন আমি একজন পঙ্গু মানুষ। আমি স্কি খেলতে ভালোবাসতাম। এখনও আমি হুইল চেয়ারে চড়ে স্কি দেখতে যাই। কোনো পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নিচের দিকে তাকাই আর মনে মনে বলি, ‘প্রভু, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আমায় বাঁচিয়েছ। আমার কোনো অভিযোগ নেই।’

আমার মতো অবস্থায় যদি কেউ পড়েন, তার প্রতি একটাই পরামর্শ- অতীতকে তো আপনি বদলাতে পারবেন না। কাজেই শুধু সামনের দিকে তাকান। সূত্র: যুগান্তর

ad

পাঠকের মতামত