মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে তখনই তাকে নিয়ে ট্রল করে: কেকা
মুঘল রসুইঘর থেকে ঢাকাই রেস্তোরাঁর কিচেন, বাবুর্চি পেশা থেকে শেফ কিংবা বেয়ারা থেকে বারিস্তা- বাংলাদেশের রসনাপ্রণালির আবর্তন কিংবা বিবর্তন, যাই-ই বলা হোক না কেন, অতি সাধারণ বিষয়াদি নিয়েই অগ্রসর হয়েছে এ দেশের রন্ধনশৈলী। তবে দেশি রান্নার ধরনে সনাতনী ধারা ব্যপকভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থেকে। ফার্সি, আরবি কিংবা ভারতের অনেক খাবারের প্রভাব রয়েছে বাংলাদেশি খাবাবের। আবার আভ্যন্তরীণ ভৌগলিক তারতম্যের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, খাদ্যাভ্যাস কিংবা রান্নার কৌশলে রয়েছে বৈচিত্র্য। যেমন, বঙ্গপোসাগর নিকটবর্তী অঞ্চলে সামুদ্রিক খাবারের প্রচলন বেশি। নারকেলের আধিক্য থাকায় তাদের রান্নার এ পদে-ও পদে থাকে নারকেলের বাড়াবাড়ি। আবার ঢাকাই খাদ্য তালিকার একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে মুগল খাবারের দখলদারি। তা যাই-ই হোক, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ঘরের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে বিকশিত করে এসেছে নারীরাই। রান্নার ক্ষেত্রেও তাই। বর্তমান সময়ে রান্না বান্না কেবল ডেগ-ডেকচি কিংবা রান্নাঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নেই। এটি রীতিমতো একটি শিল্প হিসেবে স্বকীয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে সারা বিশ্বে। আর তাই, রিমোট চেপে টিভি চ্যানেল ঘোরালেই চোখে পড়ে বিদেশি রান্না বিষয়ক চ্যানেল। যদিও আমাদের বাংলাদেশে রান্না বান্না বিষয়ক কোনো নির্দিষ্ট চ্যানেল নেই। বাংলাদেশের রান্না শিল্পকে তুঙ্গে তুলে ধরতে কাজ করে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন অনেকেই। তারমধ্যে সিদ্দিকা কবীর, মাসুম আলী রেখা ও কেকা ফেরদৌসি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রান্নায় বিশেষ অবদান রাখায় কেকা ফেরদৌসি তো এখন রীতিমতো ‘টক অব দ্য টাউন’।
ছোটবেলা থেকেই রান্না করতে পছন্দ করতেন কেকা। প্রবাসে থাকাকালীন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের অনেক রান্না শেখার সুযোগ মেলে তার। দেশে ফিরে ঐতিহ্যবাহী রান্নাসহ অন্যান্য দেশের রান্নাকে কোন পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে তুলে ধরা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন ‘কেকা ফেরদৌসীর রান্নাঘর’ নামে একটি স্কুল। দেশের ঐতিহ্যবাহী রান্নাকে জনপ্রিয় করতে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন মিডিয়াকে। ১৯৮৭ সালে তার প্রথম রান্নার অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে টেলিভিশনে তার রান্না বিষয়ক প্রচারণা শুরু হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রমজান মাসে ইফতার নিয়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কাণ্ডারি তিনিই। কেকা ফেরদৌসিই সর্বপ্রথম ঋতুভিত্তিক রান্নার অনুষ্ঠান করেন। দেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রান্না টিভি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে কেকা ফেরদৌসি শুরু করেন ‘দেশ বিদেশে রান্না’। ঐতিহ্যবাহী রান্নার খোঁজে তিনি পৌঁছে গেছেন দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সেখান থেকেও দর্শকের জন্য তুলে এনেছেন বৈচিত্র্যময় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরির কৌশল। বিশেষ দিনগুলোতে কেকা ফেরদৌসির পক্ষ থেকে থাকে ভিন্ন আয়োজন। বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, সব আয়োজনেই তিনি প্রাসঙ্গিক রান্নাকে পরিচয় করিয়ে দেন দর্শকের সঙ্গে। ২০১১ সালে শুরু করেন ‘মায়ের হাতের রান্না’ অনুষ্ঠানটি। বিশিষ্টজনদের মায়ের স্মৃতিময় পছন্দসই রান্নার এই অনুষ্ঠানটি তাকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ অনুষ্ঠানটিও তার নির্মিত আরেকটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রান্না নিয়ে তার প্রকাশিত লেখা আমাদের রন্ধনশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। রান্না নিয়ে তার লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১ টি। সবশেষ প্রকাশিত বই ‘ডায়াবেটিসের মজাদার রান্না’। ২০১৪ সালে তিনি গঠন করেন ‘কুকিং এসোসিয়েশন’। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুস্থ মহিলাদের রান্নার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কেকা। ফ্রান্স থেকে পেয়েছেন বেস্ট টিভি সেলিব্রেটি শেফ রেস্ট অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল গোলমর্ন্ড ওয়ার্ল্ড কুক বুক অ্যাওয়ার্ড-২০১০। এছাড়াও ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড-২০১১ উল্লেখযোগ্য। তিনি সম্মানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক রান্না প্রতিযোগিতার বিচারকের সম্মানে। রন্ধনশৈলী বিষয়ক তার নানা কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং সাধারণ রান্নাকে নিয়ে গিয়েছে শিল্পের মর্যাদায়।
এক টানা ২৫ বছর রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান করে আসছেন তিনি। তার এই পথচলাকে স্মরণীয় করে রাখতে আগামী ৭ জানুয়ারি চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে ‘ফুড কার্নিভাল’। সেখানে থাকবে রান্না বিষয়ক নানা আয়োজন। ফুড কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে, খানিক ফোনালাপে যোগ দেন রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসি।
রন্ধনশিল্প বিষয়ক অনুষ্ঠানে আপনার সম্পৃক্ততার ২৫ বছর পূর্তি হলো,অভিনন্দন আপনাকে। কিছু কৌতূহল ছিল রন্ধনশিল্প সম্পর্কে। প্রশ্ন করতে পারি?
কেকা ফেরদৌসি: অনেক ধন্যবাদ । হ্যাঁ, অবশ্যই করতে পারেন প্রশ্ন। তবে একটু কম সময়ের মধ্যে।
আমাদের দেশে তো রান্না বিষয়ক নির্দিষ্ট কোনো টিভি চ্যানেল নেই। এর প্রয়োজন বোধ করেন কি?
কেকা ফেরদৌসি: হ্যাঁ, আমরা তো চাই একটি নির্দিষ্ট টিভি চ্যানেল হোক। রান্না বান্নার অনুষ্ঠানের কিন্তু ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, দর্শক রয়েছে আমাদের দেশে। একটা আলাদা টিভি চ্যানেল থাকা প্রয়োজন, যেটি হবে শুধু রান্না বান্না বিষয়ক।
ধন্যবাদ। আপনি জেনে থাকবেন, বাংলার ঐতিহ্যে বেশ কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো এখন বিলুপ্ত। যেমন ধরুন- তোড়াবন্দি কিংবা শবডেগ। এ খাবারগুলো পুনরদ্ধার করা সম্ভব কী?
কেকা ফেরদৌসি: আমি তো এ বিষয়েই কাজ করছি দীর্ঘ দীন ধরে। বেশ কিছু বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী খাবার তুলে ধরার কাজই তো করছি আমি।
বাংলাদেশে বিদেশি কুইজিনের ছড়াছড়ি। মেক্সিকান, তার্কিস, আরও কতকি! আমাদের বাংলা কুইজিন কি আমরা বিদেশে বিস্তৃত করে দিতে পারি না?
কেকা ফেরদৌসি: আরে ঢাকার মধ্যেই তো বাংলা খাবারের কোনো উল্লেখযোগ্য রেস্তোরাঁ নেই, সেই অর্থে সারা বিশ্ব তো অনেক দূরের প্রসঙ্গ। তবে হ্যাঁ, আমি এই বিষয়গুলোতে ফোকাস করব ফুড কার্নিভাল অনুষ্ঠানে। সেখানে নতুনত্ব থাকবে। শিশুদের খাবার নিয়েও ভাবছি।
‘কেকা ফেরদৌসি’র কোনো উত্তরসূরি তৈরি হয়েছে কি?
কেকা ফেরদৌসি: উত্তরসূরি কী আর সেভাবে হয়! রবীন্দ্রনাথ কি কোনো উত্তরসূরি রেখে গিয়েছেন? ডাক্তারের সন্তান তো ডাক্তার নাও হতে পারে। তবে হ্যাঁ, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে, আমি মনে করি তারা রন্ধনশিল্পকে ধারণ করে রাখতে সক্ষম হবে।
একটু মনস্তাত্ত্বিক প্রসঙ্গে আসি। রান্নার স্বাদ কীসের উপর নির্ভর করে? উপাদান নাকি যিনি রান্না করেন তার উপর?
কেকা ফেরদৌসি: রান্নার স্বাদ নির্ভর করে মমতার উপর। হ্যাঁ, উপাদানের একটা প্রভাব তো থাকেই। কিন্তু আপনি লক্ষ্য করবেন যে- একই উপাদান একই পরিমাণে দুজনের হাতে তুলে দেওয়ার পর, দুজনের রান্নার স্বাদ দুরকম হয়। এখানেই কাজ করে মমতা। যার হাতে মমতা বেশি, তার রান্না তত বেশি সুস্বাদু।
আমাদের দেশ থেকে বিশ্বমানের শেফ কিংবা বারিস্তা তৈরি করতে আমরা ঠিক কতটা অগ্রসর হয়েছি?
কেকা ফেরদৌসি: না। আমরা ততটা এগোতে পারিনি। আমাদের দেশে বিশ্বমানের শেফ কিংবা বারিস্তার প্রচুর ডিমান্ড রয়েছে।
হোম ডেলিভারি কিংবা রেডিমেড খাবার- এগুলো কী আমাদের রন্ধনশিল্পের বিকাশের পথে হুমকি বয়ে আনতে পারে?
কেকা ফেরদৌসি: একদম না। আমি এটিকে হুমকি মনে করি না, এটি হচ্ছে অগ্রগতি। এখানে মেয়েরা কাজ করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ না করলে কখনোই অগ্রগতি সম্ভব নয়।
আমার শেষ প্রশ্ন- আপনাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ গণমাধ্যমে প্রচুর ট্রল হয়, হাসাহাসি হয়- এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
কেকা ফেরদৌসি: দেখুন, আসলে মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে তখনই তাকে নিয়ে ট্রল করে। এ বিষয়ে আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
আচ্ছা ঠিক আছে। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
কেকা ফেরদৌসি: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সূত্র:প্রিয়.কম