188772

‘জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার চলে নির্যাতন’

বিয়ের পর থেকেই যৌতুক নিয়ে স্বামী জাহাঙ্গীর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টানাপড়েন ছিল গৃহবধূ মৌসুমী আক্তারের। কয়েকবার মৌসুমীকে মারধর করে বাড়ি পাঠিয়েও দেওয়া হয়।

তবে সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বর মৌসুমীর জীবনে ঘটল ভয়ংকর ঘটনা।
পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে ওই রাতে মাতবরদের নিয়ে সালিস ডাকে স্বামীর পরিবার। তাতে দেওয়া রায়ে ১০১ বার দোররা মারা হয় মৌসুমীকে। এর মাঝে কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে গেলে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার চলে নির্যাতন। পরদিন ২১ ডিসেম্বর মারা যান মৌসুমী। ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার বালিয়াপুকুর গ্রামে ঘটে এ মধ্যযুগীয় ঘটনা।

এদিকে মাদারীপুর শহরের মধ্য খাগদি এলাকায় গতকাল বুধবার সালিস মীমাংসার নামে এক কিশোরীকে জুতাপেটা করেছেন স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতারা।

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে মৌসুমীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বজনরা স্বামী জাহাঙ্গীর ও সালিসকারীসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজানা ১০ জনের নামে হরিপুর থানায় হত্যার অভিযোগ এনে এজাহার দেন। তবে থানা পুলিশ গতকাল বিকেল পর্যন্ত হত্যা মামলা নেয়নি।

এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নিয়েছে তারা।
স্বজনদের চাপে মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নিলেও পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ নিহতের স্বজনদের।

তবে পুলিশ বলছে, সালিসকারীদের অন্যতম কাজি আবুল কালামকে অপমৃত্যু মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযুক্ত বাকিরা পলাতক আছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মৌসুমীর স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জানায়, ৯ মাস আগে হরিপুরের চৌরঙ্গী বাজার বালিয়াপুকুর গ্রামের মৃত সাদেকের বড় ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একই উপজেলার আমগাঁও ইউনিয়নের খামার এলাকার মৃত হবিবর রহমানের ছোট মেয়ে মৌসুমীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় জাহাঙ্গীরকে যৌতুক হিসেবে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জাহাঙ্গীর যৌতুক হিসেবে মৌসুমীর পরিবারের কাছ থেকে আরো এক লাখ টাকা দাবি করে। এ জন্য জাহাঙ্গীর প্রায়ই মৌসুমীকে মারপিট করে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত।

মৌসুমীর বড় ভাই জিন্নাত বলেন, এক লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে গত ১৬ ডিসেম্বর মৌসুমীকে মারপিট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় জাহাঙ্গীর। তখন মৌসুমী বাপের বাড়ি চলে আসেন। এরপর মৌসুমীর পরিবারের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরকে জানানো হয় যে ধীরে ধীরে তারা এই টাকা দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর তাতে রাজি হয়নি, একসঙ্গেই চাইছিল। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর কৌশলে মৌসুমীকে তার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সালিস বসায়। সালিসে গ্রামের কাজি আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামালসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

সালিসের এক প্রত্যক্ষদর্শী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না) জানান, রাত ১১টায় জাহাঙ্গীরের বাসায় গ্রাম্য সালিস বসিয়ে কাজি আবুল কালামের নির্দেশে ‘ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক’ মৌসুমীকে তওবা পড়ানো হয়। এরপর ১০১ দোররা মারা হয়। তখন মৌসুমীর চিৎকারে তিনি ও আশপাশের অনেকে ছুটে আসেন ওই বাড়িতে। কিন্তু গ্রাম্য মাতব্বরদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে মৌসুমী বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে আবার দোররা মারা হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় পরদিন মৌসুমী ওই বাড়িতেই মারা যান।

মৌসুমীর দুলাভাই আবেদ আলী বলেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে মৌসুমীর পরিবারকে জানানো হয় যে সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অথচ যেদিন মৌসুমীর মৃত্যু হয় সেদিন স্থানীয় সারের ডিলার রফিকুলের দোকানে বৈঠক করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন আবেদ আলী।

মৌসুমীর বড় বোন হাসিনা বেগম ও ফিরোজা বেগম অভিযোগ করেন, যৌতুকের সম্পূর্ণ টাকা দিতে না পারায় মৌসুমীকে প্রায়ই শারীরিক নির্যাতন করে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত স্বামী জাহাঙ্গীর ও তার পরিবারের লোকজন।

ফিরোজা বেগম জানান, মৌসুমীর মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীর ও দেবর হাসিবুল এবং কাজি আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামাল, মো. তরিকুল ও মৌসুমীর চাচি মোসা. ফরকুন বেগমের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলার এজাহার দেন। কিন্তু পুলিশ অপমৃত্যু হিসেবে মামলা নিয়েছে।

আমগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাভেল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথমে ঘটনা জানতেন না। পরে জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, দেশে আইন-কানুন থাকতে এভাবে দোররা মেরে বিচার সালিস করা আইনত দণ্ডনীয়। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ২৩ ডিসেম্বর মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মৌসুমীর শরীরে দোররার আঘাতের একাধিক চিহ্ন ছিল।

এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সুব্রত কুমার সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এদিকে গত মঙ্গলবার হরিপুর থানায় গেলে ওসি রুহুল কুদ্দুস কৌশলে দেখা না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তবে এ ব্যাপারে জেলার পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ জানান, তিনি এ ঘটনা জানতেন না। কালের কণ্ঠ’র মাধ্যমে জানতে পেরে অভিযুক্ত কালাম কাজিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিই জড়িত থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ’

মাদারীপুরে সালিসে কিশোরীকে জুতাপেটা : এদিকে মাদারীপুর শহরের মধ্য খাগদি এলাকায় গতকাল সালিস মীমাংসার নামে এক কিশোরীকে জুতাপেটা করা হয়েছে। স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতারা এ সালিস করেছেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, গত ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে ওই কিশোরীকে কৌশলে নিয়ে গিয়ে তামান্না নামে এক নারীর কাছে বিক্রি করে দেয় শহরের মধ্য খাগদি এলাকার কুদ্দুস শরীফের ছেলে হাসান শরীফ। বিষয়টি কিশোরীর পরিবার জানতে পেরে মাদারীপুর সদর উপজেলার খাকছড়ার করম বাজার থেকে তাকে শুক্রবার উদ্ধার করে।

পরে কিশোরীর পরিবার স্থানীয়দের জানালে গতকাল বিকেলে বিষয়টি নিয়ে সালিস ডাকা হয়। সালিসে উপস্থিত ছিলেন মাদারীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আইয়ুব খান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজাম খান, সাবেক কাউন্সিলর সামসুল হক খান, স্থানীয় প্রভাবশালী সেলিম মীরা, খবির খান, আকলিমা বেগমসহ শতাধিক লোকজন।

সালিসকারী আইয়ুব খান, মুজাম খান, সামসুল হক খানের সিদ্ধান্তে উল্টো ওই কিশোরীকে ১০ বার জুতাপেটার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে হাসান শরীফকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ১০ বার জুতাপেটার নির্দেশ দেন সালিসকারীরা। পরে সালিসে উপস্থিত আকলিমা বেগম নামের এক নারী কিশোরীকে জুতাপেটা করে। ঘটনার পর থেকে কিশোরীর পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।

ওই কিশোরীর ভাই জসিম ফকির বলেন, ‘আমার বোনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বিক্রি করে দেয় হাসান। এরপর আমরা বোনকে উদ্ধার করি। পরে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়ার নামে উল্টো আমার বোনকে জুতাপেটা করেছে। ’

ওই কিশোরী ক্ষোভ নিয়ে বলে, ‘আমরা কোন দেশে বাস করি। আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছে ওরা। এর বিচার তো পাইনি উল্টো সালিসের নামে আমাকে জুতাপেটা করেছে। আমি এর বিচার চাই। ’

কিশোরীর ফুফু আকিমন বেগম বলেন, ‘আমার ভাই গরিব মানুষ, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। আমরা গরিব বলে আমাদের সঙ্গে ওরা অবিচার করেছে। ’

সালিসদার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুজাম খান বলেন, ‘সালিসে দোষ প্রমাণ হওয়ায় আমরা জুতাপেটা করেছি। ’

এ ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিল আইয়ুব খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি।

তবে স্থানীয় সালিসদার আকলিমা বেগম বলেন, ‘সালিসে সিদ্ধান্ত হয় জুতাপেটা করার। সালিসদাররা জুতাপেটার নির্দেশ দিলে আমি নির্দেশ পালন করেছি। ’

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক গোলাম মাওলা আকন্দ বলেন, এ ধরনের ঘটনা সালিসযোগ্য নয়। এরপর সালিসে জুতাপেটার অভিযোগ উঠছে এক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। অভিযোগ সঠিক হলে দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাদারীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি আমার জানা নেই। যদি ওই কিশোরীর পরিবার থেকে অভিযোগ দেওয়া হয় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশকে অবহিত করেছি। দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। ’ তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা সালিস মীমাংসার যোগ্য নয়। যারা ওই কিশোরীকে জুতাপেটা করেছে তারা অন্যায় করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ad

পাঠকের মতামত