
কান্না থামছে না রিকশা চালক হাবিব ও পরিচ্ছন্ন কর্মী রহিমা খাতুনের
টিভি উপস্থাপক-ব্যবসায়ী নেতা থেকে মেয়র, সব জায়গায়ই সমান জনপ্রিয় ছিলেন আনিসুল হক। পেশাগত জীবনে যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই এনে দিয়েছেন আমুল পরিবর্তন। শত বাধা সত্বেও মেয়র আনিসুল হক তেজগাও ও গাবতলী ট্র্যাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের মত সাহসী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন।
রাজনৈতিক চাপ, পেশি শক্তির দাপট, কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। যেটা দায়িত্ব মনে করেছেন তাই বাস্তবায়ন করেছেন। মেয়র হিসেবে তেজগাঁও ও গাবতলী ট্রাক স্টান্ড উচ্ছেদ তারই ছোট্ট নির্দশন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ২ বছরের মধ্যেই রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে এনেছেন আমুল পরিবর্তন। তার উদ্যোগেই এখন অনেকটা পরিচ্ছন্ন গুলশান-বারিধারা এলাকা।
ঢাকার তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন ফার্মগেট-সাতরাস্তা সড়ক। নেই কোনো জটলা। চারলেন সড়কের মাঝখানে নান্দনিক আইল্যান্ড। নানা ধরনের গাছ ও ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। সেই যানজট, ঘিঞ্জি অবস্থা এখন চোখে পড়বে না। তকতকে, ঝকঝকে এ সড়ক এখন স্বস্তিতে চলছে যানবাহন, মানুষ।
সড়কের রূপকার বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন তিনি। মুহূর্তেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে খবরটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মূলত সদ্য প্রয়াত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রথম মেয়র আনিসুল হকের প্রচেষ্টা প্রাণ ফিরে পেয়েছে সড়কটি। সড়কের পথচারীরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এই সড়কে প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর রিকশা চালান ময়মনসিংহের গাফরগাঁও পাঁচবাগ গ্রামের হাবিবুর রহমান। বসবাস করেন তেজগাঁও বেগুনবাড়ি বস্তিতে। মূলত ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তা রুটে রিকশা চালান তিনি।
আগে প্রতিদিন ৩’শ থেকে ৪’শ টাকা ভাড়া মারতে দিনশেষ হতো এই সড়কে। এখন জটলা না থাকায় অনায়াসে ৬’শ থেকে ৭’শ টাকা ভাড়া মারেন হাবিব।
শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) সকালে অন্য রিকশা চালকের মাধ্যমে মেয়রের মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন তিনি। তখন থেকেই ভাড়া মারা তো দূরের কথা মেয়রের সড়ক উচ্ছেদের স্মৃতি তার মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। আর গভীর মমতা স্মরণ করছেন সদ্য প্রয়াত মেয়রকে।
রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের মতো আনিসুলের অন্ধ ভক্ত পরিচ্ছন্ন কর্মী রহিমা খাতুন। কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, ‘মেয়র সাহেব কইতো- ওরা কাজের মানুষ, ওরাই নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। খুব কষ্ট কইরা নগরীটারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেই কাজ করতো। ওগো কি সমস্যা সেগুলো আগে দেখো।’
মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে কাছে স্মৃতিচারণ করে মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে বাংলানিউজের কাছে স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-১ এর পঞ্চাশোর্ধ পরিচ্ছন্ন কর্মী রহিমা খাতুন।
শুক্রবার (০১ ডিসেম্বর) রাজধানীর উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের বিডিআর মার্কেটের সামনে ডিএনসিসির ২ নম্বর ড্যাম্পিং স্টেশনে কাজ করার সময় কথা হয় এই পরিচ্ছন্ন কর্মীর সঙ্গে। কথা বলার সময় তিনি কাঁদছিলেন।
‘আমরা যে খুব ভোরে উঠে নগরীর পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করতাম, এটা মেয়র সাহেব জানতেন, বুঝতেন। তিনি খুব ভালো লোক ছিলো। আমাগো অনেক সুযোগ-সুবিধা দিছে। আরও সুবিধা দিতে চাইছিল’, বলেন রহিমা খাতুন।
অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে এই পরিচ্ছন্ন কর্মী বলেন, আমি খালি মেয়র সাহেবের ছবি দেখছি কিন্তু তারে সরাসরি কখনও দেখি নাই। সবার মুখে শুনতাম যে মেয়র সাহেব খুব ভালো মানুষ। তাই তারে একবার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তারে দেখতে পারলাম না!
পরিচ্ছন্ন কর্মী রহিমা খাতুন আরও বলেন, আগে একজন পরিচ্ছন্ন কর্মীর বেতন ছিল ৩ হাজার। তাও ঠিকমতো পাইতো না। মেয়র সাহেব আসার পর থেকে আমাদের বেতন বাড়ছে, সুবিধা বাড়ছে, আমরা পরিচ্ছন্ন কাজ করতে নতুন জিনিসপত্র পাইছি। যে যেমন কর্ম করে তার বেতন মেয়র সেইভাবেই বাড়াইছে।
নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে মেয়র আনিসুল হক খুব গুরুত্ব দিতেন বলে জানান পরিচ্ছন্ন কর্মীরা।
প্রসঙ্গত, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাতে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আগামীকাল শনিবার বেলা ১১টা ৪০মিনিটে আনিসুল হকের মরদেহ ঢাকায় আনা হবে। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ তাঁর বাসায় নেওয়া হবে। ওই দিন বাদ আসর তাঁকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে পরিবারের একটি সূত্র জানিয়েছে।
গত ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান মেয়র আনিসুল হক। অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৩ আগস্ট তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর শরীরে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন চিকিৎসকেরা। এরপর তাঁকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে মেয়রের শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তাঁর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মঙ্গলবার মেয়রের পরিবারের একজন সদস্য বলেন, রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাঁকে আবার আইসিইউতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাতে মেয়রকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি, ব্যবসায়ী ও একসময়ের টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর শৈশবের একটি বড় সময় কাটে ফেনীর সোনাগাজীর নানার বাড়িতে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে টিভি উপস্থাপক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিসুল হক। তাঁর উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠান দুটি জনপ্রিয়তা পায়। তবে পরে টেলিভিশনের পর্দায় মানুষ তাঁকে বেশি দেখেছিল ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেই। ২০০৫-০৬ সালে বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হন তিনি। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল মেয়াদে সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন আনিসুল হক।