179963

‘আমরা মেঝেতে ওই রক্তের পাশেই শারীরিকভাবে মেলামেশা করি’

রাজধানীর বাড্ডায় বাবা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডটি ‘ডাকাতি’ হিসেবে প্রমাণ করতে খুনের পর আরো লোমহর্ষক ও পৈশাচিক কাণ্ড ঘটায় খুনিরা। গ্রেপ্তারকৃত আর্জিনা বেগম দাবি করেছেন, স্বামী জামিলকে খুন করতে পারলেই প্রেমিক শাহীনকে বিয়ে করা সম্ভব—এই চিন্তা থেকেই তিনি হত্যার পরিকল্পনাটি করেছিলেন।

তাঁর আরো দাবি, প্রেমিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জামিলকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হবে। কিন্তু বালিশচাপা দিতে গিয়ে জেগে ওঠায় জামিলকে পিটিয়ে হত্যা এবং এ হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলায় জামিলের সাত বছরের মেয়ে নুসরাতকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ পাশে রেখে এবং রক্তাক্ত মেঝেতে তারা পৈশাচিক কাণ্ড করে।
ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীর আদালতে সম্প্রতি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব দাবি করেন আর্জিনা বেগম। তিনি আরো দাবি করেন, তাঁর স্বামী প্রাইভেট কার চালানোর পাশাপাশি সুদের ব্যবসা করতেন। স্বামীর অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে চিকিত্সার খরচ দিতেন না। উল্টো আর্জিনাকে মারধর করতেন এবং বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক আনতে বলতেন। এসব কারণে স্বামীর প্রতি অনীহা সৃষ্টি হলে তিনি শাহীনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তবে মামলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, খুনের অপরাধ লঘু করতে অনেক সময় আসামিরা বিভ্রান্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

জবানবন্দিতে আর্জিনা বলেন, গত ২ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে তাঁরা রাতের খাবার খেতে বসেন। জামিলের বড় ভাই ইব্রাহিমও খেতে বসেন। খাওয়ার সময় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ মেশানো একটি তরকারি কৌশলে জামিলকে খাওয়ানো হয়। খাবার-দাবার শেষে আর্জিনার ভাশুর ইব্রাহিম বিদায় নিয়ে চলে যান। এরপর রাত ১১টার দিকে বিছানায় স্বামী জামিল দুই সন্তানকে নিয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। তখন টিভি দেখতে আসে বাসায় সাবলেটে থাকা প্রেমিক শাহীন। একপর্যায়ে জামিল ঘুমিয়ে পড়েন। বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর শাহীন তার এক বন্ধু খোয়াজ আলীকে ফোন দিয়ে বলে, ‘কাজ হয়ে গেছে, চলে আয়। ’ এ কথা বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আর্জিনাও ঘরের দরজার ভেতর থেকে না আটকিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়েন।

জবানবন্দিতে আর্জিনা বলেন, রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার সময় শাহীন ঘরে ঢোকে। সে জামিলের বুকের ওপর উঠে বসে। আর্জিনা জামিলের হাত চেপে ধরে। শাহীন ও তার বন্ধু খোয়াজ আলী বালিশ দিয়ে জামিলের নাক-মুখ চেপে ধরে। এ সময় জামিল জেগে উঠে বসে পড়েন। তখন খোয়াজ দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়। সে ফেরেনি। জামিল তখন উঠে বসে বলেন ‘ওরা কে, ঘরে ঢুকল কিভাবে। ’ তখন শাহীন দৌড়ে বাইরে গিয়ে একটি কাঠের টুকরা নিয়ে ফিরে আসে। এর মধ্যে জামিল বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় শাহীন কাঠের টুকরা দিয়ে জামিলের মাথায় বাড়ি দেয়। জামিল চিত্কার দিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। এ সময় মেয়ে নুসরাত জেগে উঠে চিত্কার দেয়। শাহীনকে চিনতে পেরে বলে, ‘আপনি আমার বাবাকে মারছেন কেন?’ শাহীন তখন ঘর থেকে আবার বের হয়ে যায়। নুসরাত তখন মা আর্জিনাকে বলে ‘শাহীন আঙ্কেল বোধ হয় আমার বাবাকে চোর ভেবে মেরেছে। ’ তখন আমি ঘরের লাইটটি জ্বালিয়ে দেই। শাহীন ফের ঘরে ঢুকে নুসরাতকে বলে, ‘তুমি আমার ঘরে চলো। তোমার বাবার মাথা থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছে। তুমি রক্ত দেখে ভয় পাবে। ’ এ কথা বলে সে নুসরাতকে তার ঘরে নিয়ে যায়। ছেলে ‘আলফিও’ তখন জেগে গিয়েছিল। তাকেও শাহীন তার স্ত্রী মাসুমার কাছে রেখে আসে। এরপর শাহীন ওই কাঠের টুকরা নিয়ে আবার ওই ঘরে ঢোকে। তখনো জামিল রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় ঢুলছিলেন। শাহীন আবার তার মাথায় লাঠিটা দিয়ে বাড়ি দেয়। পরে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

আর্জিনা বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল জামিলকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে স্ট্রোক করে মারা গেছে, এ কথা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু জামিল রক্তাক্ত থাকায় এটা বলা সম্ভব ছিল না। তখন শাহীন আমাকে বলে যে সবাইকে বলতে হবে, ঘরে ডাকাত ঢুকে জামিলকে মেরেছে এবং তোমাকে ধর্ষণ করেছে। এ জন্য শাহীন আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়। ’ আর্জিনা বলেন, ‘জামিলের দেহ তখন বিছানায় পড়েছিল। কিছু রক্ত মেঝেতেও ছিল। আমরা মেঝেতে ওই রক্তের পাশেই শারীরিকভাবে মেলামেশা করি। ’ পরে মেয়ে নুসরাতকে হত্যা করেও একই ধরনের পৈশাচিক কাণ্ড করে শাহীন ও আর্জিনা।

জবানবন্দিতে আরো বলা হয়, জামিলকে হত্যার পর আর্জিনাকে নিয়ে শাহীন নিজের ঘরে যায় এবং স্ত্রী মাসুমাকে সব খুলে বলে, ‘যা হবার হয়েছে, সবকিছু ভুলে যেতে হবে। ’ কিছুক্ষণ পর শাহীন নুসরাতকে নিয়ে রুম থেকে বের হয় এবং বাবার লাশের পাশেই তাকেও হত্যা করে ফেলে রাখে। আর্জিনার দাবি, তখনো মেয়েকে হত্যার বিষয়টি তিনি বোঝেননি। পরে শাহীন আলফিকে কোলে দিয়ে স্ত্রী মাসুমাকে ঘরের বাইরে পাঠায় এবং দরজা বন্ধ করে আবারও আর্জিনার সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা করে। পরে শাহীন তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় ডাকাতির ঘটনা মানুষকে বিশ্বাস করাতে আর্জিনার টাকা-পয়সা ও গয়না নিয়ে যায়। এরপর ছাদে গিয়ে আর্জিনা কাঁদতে থাকেন এবং ডাকাতির বিষয়টি মানুষকে বলেন। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাঁকে আটক করে।

আর্জিনা তাঁর জবানবন্দিতে আরো বলেন, ২০০৭ সালে জামিল সেখের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ২০০৯ সালে তার মেয়ে নুসরাত জাহান জন্মগ্রহণ করে। ২০১৩ সালে তাঁর ছেলে আলফি সেখ জন্মগ্রহণ করে। তাঁর স্বামী জামিল গুলশানে একজনের বাসায় প্রাইভেট কার চালানোর পাশাপাশি লোকজনকে সুদের ওপর টাকা ধার দিতেন। তাঁকে মারধর করতেন। তাঁর অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী অসুস্থ হলে চিকিত্সার জন্য টাকা দিতেন না। উল্টো যৌতুক চাইতেন। এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ ছিল। এ অবস্থায় আগের বাসায় থাকার সময় শাহীনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আলাপের সূত্র ধরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়।

ad

পাঠকের মতামত