179213

যুব সমাজকে নেশার ভয়ংকর ছোবল থেকে ফেরাতে একজন পুলিশ সুপার সালমার ব্যতিক্রমি ভাবনা

বরাবরই ব্যতিক্রমতার স্বাক্ষর রেখে খুব অল্পদিনেই সাধারন মানুষের নজর কেড়েছেন রাজবাড়ী জেলা পুলিশ সুপার সালমা বেগম (পিপিএম)। গদবাধা সরকারী দায়িত্বের বাইরেও সমাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কিছু করার দায়বদ্ধতা থেকে এই তড়িৎকর্মা পুলিশ অফিসার সার্বক্ষনিক নজর রেখে চলেছেন পুরো জেলার উন্নয়ন পরিকল্পনায়।
ইতমধ্যে জেলায় বেশ কয়েকটি বাল্যবিবাহ রোধ, আলোচিত অপরাধ দমন, মাদক নির্মুল অভিযানসহ নিজের কর্তব্যনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তিনি।
ব্যতিক্রমি এই নারী পুলিশ অফিসারের এমন উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে সব মহলেই।
নিজ দায়িত্বের বাইরেও কখনো তার দেখা মেলে অসহায় কোন দরীদ্র অথবা নির্যাতিত মানুষের দোরগোড়ায়, কখনো আবার ছুটে যান কোন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের পড়াশোনার খোজ খবর নিতে।

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রতিটি অঙ্গনে এভাবেই একজন ব্যতিক্রমি ভাবনার পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচিত তিনি।

সারাদেশজুড়ে মাদকাসক্তির ভয়ালগ্রাস নিয়ে উদ্বিগ্ন এই পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন তার ভাবনার কথা। মাদকের ভয়ালগ্রাস রুখতে আবশ্যক জরুরী অনেক বিষয় নিয়ে পুলিশ সুপার সালমা বেগমের সাথে কথা বলেছেন সময়ের কণ্ঠস্বরের স্টাফ রিপোর্টার রাজু আহমেদ।

মাদকাসক্তির কুফল ও প্রতিকার শীর্ষক ভাবনায় সালমা বেগম

মাদক,মাদকাসক্তির কুফল ও ভয়াবহ দংশনে দেশ ও জাতির অগ্রগতির চাকা আজ থমকে গেছে। এই করুন পরিস্থিতির অনাবশ্যকীয় গতি রোধ করতে হবে। মাদকাসক্তির কুফল ও প্রতিকার শীর্ষক আলোচনার ফাঁকে এসব কথা বলেন রাজবাড়ী জেলা পুলিশ সুপার সালমা বেগম (পিপিএম)।

আলোচনার শুরুতেই তিনি জানান, মাদক একটি সামাজিক সমস্যা। বর্তমানে মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এক সর্বনাশা ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করছে। দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই তা আমাদের তরুণ সমাজকে গ্রাস করছে। এর তীব্র দংশনে ছটফট করছে আমাদের সমাজের আগামী দিনের ভবিষ্যৎরা। মাদকের ভয়াবহ পরিণতি দেখে আজ প্রশাসন বিচলিত, অভিভাবকরা আতঙ্কিত চিকিৎসকেরা দিশেহারা। এর কারণ যে তরুণ যুবশক্তি দেশের প্রাণ মেরুদ-, নেশার ছোবলে আজ সেই মেরুদ- ভেঙ্গে পড়ে যেতে বসেছে। নেশার ছোবলে মৃত্যুতে ঢলে পড়ছে লক্ষ প্রাণ ধ্বংস হচ্ছে পরিবার ও সামাজিক শান্তি। রাষ্ট্র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি দেখতে পাচ্ছে। দাবাগ্নির মতো এ সামাজিক ব্যাধি যেনো ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে শুরু করে সবুজ শ্যামলে ঢাকা গ্রাম বাংলায়। মাদকাসক্তি সমস্যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে তোলপাড় তাতে আমাদের দেশও শামিল হয়েছে।

তারপরেও এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে এর কুফল জানাতে হবে সবাইকে গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা।দেশের সহজলভ্য মাদকদ্রব্য হলো ভেষজদ্রব্য, যা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিষ্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায় বা থাকে না বললেই চলে। মাদকদ্রব্য গ্রহণে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় না থেকে অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যায় এবং তার ফলে এক সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।

আলোচনার এক পর্যায়ে পুলিশ সুপার সালমা বেগম বলেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত মানবকল্যাণে সৃষ্ট ভেষজদ্রব্য যা নির্দিষ্ট মাত্রায় চিকিৎসকরা রোগীর সেবায় ব্যবহার করে থাকেন তার অপব্যাবহার ও মাত্রাধিক্যতায় সমাজের অসাধু লোকদের ফলে সেই কল্যাণকর ভেষজদ্রব্যই অকল্যাণকর মাদক হয়ে উঠেছে। তবে মাদকদ্রব্যের উপাদান সমূহের ব্যবহার চিকিৎসা শাস্ত্রের তুলনায় অপব্যবহারই বেশি হচ্ছে।

 

মাদকদ্রব্যের বেদনা নাশক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, আনন্দচ্ছাস, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, শ্বাসপ্রশ্বসের আবনমন, রক্তচাপ থ্রাস, বমনেচ্ছা ও বমি কোষ্টবদ্ধতা ও মূত্র থ্রাস, অস্তক্ষরাগ্রন্থি ও স্বতঃক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তনসহ অপর্যাপ্ত ঘুম ও নিদ্রাজনিত সমস্যা।

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য চালু আছে। মদ, গাঁজা, ভাঙ, আফিম, চরস, ভদকা প্রভৃতি নেশাকর দ্রব্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বর্তমানকালে মাদকদ্রব্য হিসেবে হিরোইন, মারিজুয়ানা এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মরফিন, পপি, হাশিশ, ক্যানবিস, স্মাক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে হেরোইন, কোকেন মূল্যবান। আমাদের যুবসমাজ সাধারণত যেসব ড্রাগগুলোকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে সিডাকসিন, ইনকটিন, প্যাথেড্রিন, ফেন্সিডিল ইত্যাদি উল্লেখ্য প্রধান। তাছাড়াও ইয়াবা নামক মাদকের সর্বনাশা ছোবল বর্তমান যুবসমাজকে দংশন করছে।

মাদকাসক্তি এমন এক দুর্বার নেশা যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। মাদক কীভাবে মানুষকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলে তা সে নিজে জানে না, বুঝতে পারে না এবং অপরকে বুঝতে দেয় না। তাই মাদকের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে বাঁচতে এর কুফল সম্পর্কে জানতে হবে জানাতে হবে অপরকে। বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনতা।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড) গোল্ডেন কি্নসেন্ট (আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান) গোল্ডেন ওয়েজ হেরোইনের মূল উৎস।

এ সমস্ত দেশে আফিমের চাষ করা হয় যা মাদকের প্রাচীন উপাদান। পপি ফুলের নির্যাস থেকে কৃষকরা তৈরি করেন কাঁচা আফিম। তা থেকে মরফিন ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় হেরোইন উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন তথ্য প্রাপ্তি হতে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, জ্যামাইকা, প্যারাগুয়ে, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আক্রিকা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হয়। দক্ষিণ আমেরিকা, পেরু, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া কোকেন উৎপাদনকারী দেশ। মেঙ্েিকা, যুগোশ্লাভিয়া, হাঙ্গেরীর সীমান্ত প্রদেশ, সাইপ্রাস, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, অস্ট্রেলিয়ার তাসমেনিয়ায় হেরোইন ও আফিমের উৎপাদন হচ্ছে। বিভিন্ন অবৈধ পন্থায়, চোরচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসব মাদক পাঁচার হয়ে আসে।

যারা নেশা করে তাদের অধিকাংশই জানে নেশা ভালো কাজ করে না। মাদকের নেশা জীবন নষ্ট করে জেনেও তারা নেশার মধ্যে থাকতে চায়-এ যেনো রবীন্দ্রনাথের “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান” গানের মতোই। আমাদের যুবসমাজ নেশায় মেতে উঠার কারণ কি ? এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকদ্রব্য বা নেশার আসক্তির যে কারণগুলো নিন্নরুপভাবে চিহ্নিত করেছেন।

সঙ্গীদের চাপ এবং বন্ধুদের কাজ সমর্থনের চেষ্টা। এ কথা খুবই সত্য যে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে তাদের মধ্যে যদি মাদকের নেশা চালু থাকে তবে সেই কাজে অঙ্গ নিতে মাদকাসক্তরা বাধ্য করে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মাদকাসক্তরা এভাবে নেশাগ্রস্ত বা মাদকাসক্ত হয়।নেশার প্রতি কৌতুহল, যৌবন ও কৈশরে এমন একটা সময় আসে যখন অজানাকে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। কৌতুহলের বশে কেউ যদি মাদকের জালে আটকা পড়ে তাহলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কষ্ট। সহজে আনন্দ লাভের বাসনা, মানুষ অনেক সময় ভুল করে সহজে আনন্দ লাভের বাসনায় সহজ উপায় হিসেবে মাদকের প্রতি ঝুঁকে এবং ধীরে ধীরে তা নেশায় পরিণত হয়।

 

প্রথম যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব, কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে ছেলে-মেয়েরা বিদ্রোহী মনোভাবের মধ্য দিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে চায়। যা করতে গিয়ে তারা ভালো মন্দ বিচার না করে সামগ্রিক অনেক নিয়ম কানুন ভাঙ্গতে চায়।মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা,তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তির বিস্তৃতির একটা কারণ হতাশা তারা, শোক, বিষাদ, বঞ্চনার চেতনাকে চায় নেশায় আচ্ছন্ন করতে।প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ, বহুক্ষেত্রে বাবা-মায়ের মধ্যকার খারাপ সম্পর্ক এবং ঝগড়াঝাটি, বাকবিতন্ডার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অমানবিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে এ ধরনের পারিবারিক পরিবেশ বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত।

ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে ছেলে-মেয়েরা খারাপ বন্ধুদের সাথে সৌহার্দ্য গড়ে তোলে।পারিবারিক পরিমন্ডলে পড়ে মাদকের প্রভাব।পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্তদের পিতা-মাতার ভেতর মাদকাসক্তি বা নেশার অভ্যাস ছিলো।ধর্মীয় অনুভূমির অভাব,পৃথিবীর প্রতিটি দেশের লক্ষ্য করা গেছে যে ধর্মীয় বিধি নিষেধের প্রতি অবজ্ঞা মাদকাসক্তি বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পিতা-মাতাকে সন্তানদের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলতে হবে।

শিক্ষা কার্যক্রমে বিষয়টির প্রতি অনুপস্থিতি, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং সুস্থভাবে সুুশিক্ষা গ্রহণে ছেলে-মেয়েদের আগ্রহী করতে আমাদের অপারগতা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মাদকাসক্তি বৃদ্ধির একটা বড় কারণ।চিকিৎসা সৃষ্ট মাদকাসক্তি, বহু নেশাগ্রস্তরা মাদকদ্রব্য প্রথম গ্রহণ করে ডাক্তারের নির্দেশে। তারপর সতর্ক তত্ত্বাবধানের অভাবে ও ব্যবস্থাপত্র ঘন ঘন ব্যবহারের কারণে সেই জীবন রক্ষাকারী ঔষুধই একদিন মাদক হয়ে ওঠে।মাদকের সহজলভ্যতা,মাদকের সহজলভ্যতা হয় মাদকের উৎপাদন, আমদানি এবং চোরাচালানের মাধ্যমে। অতএব মানুষ নেশা করার সুযোগ পাবে না যখন তার হাতের কাছে সহজলভ্য দ্রব্যের মতো বিষাক্ত মাদক না থাকবে।

মাদক ও মাদকাসক্তির কোনো ধরণের ভালো দিকই নেই,সবটাই কুফল সবটুকুরই খারাপ দিক। মাদকাসক্তি মারাত্মক রকমের অসুস্থতা। এইডস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো এটিও ভয়াবহ রোগ।

মাদকাসক্তির ফলে শরীর ও মন এমন অবস্থায় পৌঁছে যে মাদক না নিলে প্রত্যাহারজনিত কারণে আসক্তের শরীরে নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। মাদকের আসক্তি মানুষের জীবনে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, অধ্যাত্মিক বিভিন্ন ধরণের কুফল দেখা দেয় ।সাধারণভাবে তামাক বা সিগারেটের মাধ্যমে মাদকাসক্তের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। একজন ধূমপায়ী নিজের ও অধুমপায়ীদের নানা শারীরিক সমসন্যা ও জটিল রোগের কারণ হতে পারে। ধুমপানের মাধ্যমে যে ক্ষতিপয় দিকগুলো সমীক্ষায় উঠে এসেছে নানা ক্ষতিকর দিক।

একটি সিগারেটের ধোয়ায় ১৫ বিলিয়ন পদার্থের অনু থাকে যা সব মানুষের জন্যেই ক্ষতিকর। একটি সিগারেটের ফলে একজন ধুমপায়ীর ৫.৫ মিনিট আয়ু কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমাতা কমে যায়।ধুমপায়ীদের মধ্যে পুরুষত্বহীনতা, গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ বা অন্ধ হতে পারে। স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো জটিল রোগ হতে পারে।বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখ লোক ধুমপানের কাণে ক্যান্সরে আক্রান্ত হয়। ফুসফুস ক্যান্সারে যতো লোক মারা যায় তাদের ৮৫ জন ধুমপায়ী। ব্রংকাইটিস ও হৃদরোগ ধুমপায়ীদের স্বাভাবিক অসুখ। প্রতি বছর ৫০ লাখ লোক অর্থাৎ ৬.৫ সেকেন্ডে ১ জন প্রাণ হারায়। এছাড়া হাঁড় ও দাঁতের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে।এছাড়া অন্যান্য মাদক যেমন : হেরোইন, গাঁজা, মদ, আফিম, পেথেডিন প্রভৃতি মাদক গ্রহণে কর্মক্ষমতার অবনতি, ক্ষয় রোগ, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, যকৃতের তীব্র প্রদাহ, রক্তা দূষণ, এইডস ও প্রজননতন্ত্রের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ও রোগে ভোগেন মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা।

মাদকের কালো থাবা এমনভাবে মানুষকে গ্রাস করে যাতে মানসিক উশৃঙ্খলা, অবসাদ, বিষণ্নতায় ভোগে আসক্তরা। মাদকের প্রতি নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে। নেশার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইচ্ছায় বিরুদ্ধে তাকে নেশা গ্রহণ করতে হয়। মাদকদ্রব্য ক্রয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্যে অপরাধ জগতে সে নিজেকে সমর্পন করে। ড্রাগ নেয়ার স্বার্থপরতা, প্রনিশোধ স্পৃহা রাগ, জিদ, ভয়, লজ্জা, হিংসা, ঘৃণা, সংকোচ, হতাশা, আত্মদুঃখ, একাকিত্ব ইত্যাদি নেতিবাচক পরিবর্তন তার আচরণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। কোনো ঘটনায় সে অতি প্রতিক্রিয়া করে আবার কখনো কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না। প্রকৃতপক্ষে কোনো অনুভূতির মূল্য সে দিতে জানে না। সে শুধু বেঁচে থাকে ড্রাগ ব্যবহারের জন্যে। আর ড্রাগ নেয় বেঁচে থাকার জন্যে।

কোনো পরিবারের ছেলে, স্বামী, মেয়ে যে কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হলে সমগ্র পরিবার সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হয়। সমাজে সবাই এদের অপরাধী মনে করে এবং সে নজরেই দেখে। কারণ নেশার পয়সা জোগাড় করতে এ ব্যক্তিরা নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি কারো কাছে মান সম্মান থাকে না। ঘরে ভাই বা বাবা কেউ মাদকাসক্ত হলে বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে দেয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ এ পরিবারের সদস্যদের কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। সমাজে এরা অবহেলিত, অযাচিত, অপাংতেয়। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণও মাদকাসক্তি।

নেশার টাকা যোগানোর জন্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই অপকর্ম ছাড়াও ঘরবাড়ি হতে আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র বিক্রি করে মাদকাসক্তরা নিজে সর্বশান্ত হচ্ছে পরিবারকেও পথে বসাচ্ছে। এমনও ঘটনা আছে যে, নেশার টাকা না দিতে পারায় মাদকসক্তরা খুন পর্যন্ত করেরেছ পরিবারের সদস্যকে। কারণ তখন বাবা-মা, ভাই-বোন সম্পর্কে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।মাদকের ফলে রাষ্ট্রীয় সমস্যার মূল কেন্দ্র রয়েছে পরিবার। কারণ পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হলে সে পরিবারের অশান্তি আর ভোগান্তির সীমা থাকে না। মাদকাসক্তি কেবল আসক্ত ব্যক্তিরাই ক্ষতিগ্রস্ত করে না। তার পরিবারের সকল সদস্যদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কত ঘর ভেঙ্গে যায়। বিকশিত হবার আগেই হারিয়ে যায় কত উদীয়মান প্রতিভা। বিধবা হয় কত নারী, কত শিশু এতিম হয়। মাদকাস্ত ব্যক্তিরা পরিবার সমাজে অস্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বীকার হয়।মাদকাসক্তিও এর প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যবস্থা করতে তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হচ্ছে।

অনেক যুবতী ও নারীরা পতিতাবৃত্তি পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ফলে জন্ম হয় সামাজিকভাবে পঙ্গু সন্তানের।ড্রাগ বা মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের পরিবারের সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। সকল সৎ গুণ, ক্ষমা, ধৈর্য, বিনয়, সহনশীলতা ইত্যাদি মূল্যবোধ বিলুপ্তির ফলে সে মানসিক ও আত্মিক শূন্যতায় ভুগতে থাকে। ফলে সবদিক থেকে সে দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, মাদকাসক্তি যেহেতু সামাজিক ব্যাধি তাই এ সমস্যা সমাধানের উপায় ও সমাজকে বের করতে হবে। এজন্যে সামাজিকভাবে মাদক ব্যবহারের প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং তা বৃদ্ধি করতে হবে এবং তা বৃদ্ধি করতে হবে সমাজে সকল স্তরে। এক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদকের প্রতিকার করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয় ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকরভাবে একান্ত প্রয়োজন।পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে মাদক বিরোধী অভিযান এক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বোন মাদকের কুফল ও ভয়াবহতা সম্পর্কে পারিবারিক আলোচনা ও তা থেকে বিরত থাকতে পরিবারকে উৎসাহিত করবেন।পিতা-মাতাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে।

কারণ, ছেলে মেয়েদের সঠিক তথ্য জানানোর দায়িত্ব স্কুল ও অভিভাবকের উপর। তা না হলে ভুল মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে সঠিকভাবে বুঝতে নাও পারে।সর্বোপরি পরিবারে সদস্যদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে।সাংস্কৃতিক দিক হতে তরুণদের আকর্ষণযোগ্য আদর্শ কার্যক্রম সামনে তুলে ধরতে হবে। যা তাদের গতানুগতিক ব্যস্ত জীবন থেকে স্বস্তি ও বিনোদন দেবে।ধূমপানসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার দমন আইন ও ধারাসমূহের বাস্তবায়ন করতে হবে কঠেঅর হস্তে। তা না হলে ৫০ টাকা জরিমানা করা শাস্তিযোগ্য ধুমপান যেমন অবাধে চলছে, ভবিষ্যতেও তেমনি চলতেই থাকবে।মাদক চোরচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে সেভাবে আমাদের দেশ ব্যবহৃত হচ্ছে তা রোধ করতে প্রশাসনকে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বিপণনে অনুৎসাহিত করে এগুলোর উপর শুল্ক ও কর বৃদ্ধি করতে হবে।মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে।বেকার যুবকদের জন্যে কর্মসংস্থান বা আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে।শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে মাদক বিরোধী সচেতনতামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, টেলিভিশন, বেতার ও পত্র-পত্রিকায় মাদক ও মাদকাসক্তদের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রচার করতে হবে যাতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ব্যপারে অনুৎসাহিত মনোভাব গড়ে ওঠে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে এ ব্যাপারে সভা, বিতর্ক, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা যেতে পারে। তাতে জনসচেতনতা বাড়বে।
মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা ছোবল দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের ও আগামী দিনের সুস্থ সুন্দর ও সুখকর সমাজের জন্যে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধ করতে হবে। আর তার জন্যে প্রয়োজন ব্যক্তিগত উদ্যোগ সামাজিক প্রতিরোধ এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ। আমরা আশা করছি সময়ের ব্যবধানে এসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আগামী প্রজন্মকে উপহার দেবে একটা মাদকমুক্ত সমাজ।

সূত্র: সময়ের কণ্ঠস্বর

ad

পাঠকের মতামত