179005

দোষ কি ১৪টি দুধের বাচ্চার, কেন জীবন্ত কবর?


পাঠক, আপনারা হয়তো চৌদ্দ বাচ্চা জীবন্ত কবর দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পড়ছেন। তবে এই চৌদ্দ বাচ্চা মানুষের নয় কুকুরের…। কারণ ‘নিষ্ঠুর প্রাণী’ হিসেবে মানুষ যেন অতুলনীয়। মানুষের নিষ্ঠুরতার ধরন নির্মম। মানুষের আধিপত্যের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অন্যান্য প্রাণীর ওপর। মানুষের আগ্রাসন প্রাণী জগতের জন্য এতটাই বিপর্যয়কর যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণীর ক্রমবিকাশের ধারা বদলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেইসাথে মানুষের নিষ্ঠুরতার মাত্রাও ছাড়িয়েছে ভয়াবহভাবে, তা বোঝা গেল প্রায় এক সপ্তাহ আগে দুই মা-কুকুরসহ ১৪টি দুধের বাচ্চাকে জীবিত পুঁতে ফেলা দেখে।

 

রাজধানীর হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টের বাগিচারটেক কল্যাণ সমিতির নির্দেশে এ কাজ করেছিলেন এলাকার নিরাপত্তারক্ষী সিদ্দিক। কি বিভৎস..! কোন মানুষকে যদি এভাবেই পুঁতে দেয়া হতো তাহলে আপনার মনের চিত্রটি কেমন হতো..? একবার ভেবে দেখুন তো কুকুরের বাচ্চা কিংবা পশু বলে কি এমন অমানবিকতা? অথচ মাস কয়েক আগেই রাজশাহীতে একটি কুকুর মানুষের ফেলে দেয়া বাচ্চাকে বাঁচালো, পাশে থেকে রক্ষা করলো শিশুটিকে। কই সেই পশুটিতো মানুষের বাচ্চাটিকে মেরে ফেলেনি। আর এই বোবা প্রাণীটির নিরপরাধ বাচ্চাকে জীবন্ত কবর..!

 

এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি সাভারে কুকুর ছানা কে চক্রাকারে ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত আঁছড়ে মারার একটি ভিডিও প্রচার করেছিল হত্যাকারী নিজেই। এসব দেখে একটি প্রশ্নই জাগে, এসব কি পাপ নয়? এ পাপের কথা কি ধর্মে নেই? হাতিরঝিলের এই ঘটনাটি ঘটে মসজিদের কাছেই। কোন মুসল্লি কি এই অপরাধের প্রতিবাদ করতে পারতেন না? এই প্রাণীজগত কার সৃষ্টি? তবে সেসব মানুষদের কি সৃষ্টিকর্তার ওপরই বিশ্বাস নেই? সৃষ্টিকর্তা কি তার দেয়া কোন জীবনকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করার অধিকার মানুষকে দিয়েছে কি?

 

২.
মানুষ তার আশপাশের হিংস্র পশুদের এক সময় নিজের নিরাপত্তার কারণে ধরে ধরে হত্যা করেছে। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানুষের সবচেয়ে কাছের যদি কোন প্রাণী থাকে তবে সেটি পথের কুকুর। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এই কুকুরই প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাওয়া পশুদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তাহলে তাদের প্রতি কেন বারবার পাশবিকতা! এই পাশবিকতায় কখনো করছে রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো আবার কখনো জনগণ। কিন্তু কেন..? এর উত্তরে অধিকাংশ মানুষই দায়ী করেন কুকুর কামড়ানোকে। কি হয় আঁচড় দিলে বা কামড়ালে?

বেশিরভাগ মানুষেরই ভ্রান্ত ধারণা কুকুরের কামড়ে পেটে বাচ্চা হয় বা মারা যায় মানুষ! আসলে কি তাই? না জেনেই সভ্য শিক্ষিত জাতির এ কেমন আচরণ…? শুধু কুকুরই নয়, ইদানিংকালে বেড়েছে অন্যান্য পশুদের ওপরও অমানবিকতা! রাজবাড়ী সদর উপজেলার বাণীবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন মাঠে গেল শুক্রবার রাতে চার পা বেঁধে পায়ুপথ ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে একটি ঘোড়াকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।আর গত ৩ অক্টেবর ছিল বিশ্ব প্রাণী দিবস__ওইদিনই সিলেটে প্রশাসন শুরু করে কুকুর নিধন। এ বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন খাবার বিষ দিয়ে শতাধিক কুকুর নিধন করে। প্রাণী কল্যাণে কাজ করা বন্ধুরা বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। এতে ফুঁসে উঠেন প্রাণীপ্রেমিরা। তাদের ডাকে রাস্তায় নামেন শত শত মানুষ। এরপর তা থামলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ঠিকই চলছে এই নিধন।

৩.
সরকারি সংস্থাগুলো যখন কুকুর নিধন করে তারা কি জানে না যে, মহামান্য হাইকোর্টের রুল আছে কুকুর নিধনে? আজও আদালতের পানে চেয়ে বোবা প্রাণীগুলো। এতে প্রশ্ন জাগে, উচ্চ আদালতের রীট শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে কি তবে? আইনের প্রয়োগ কি হবে না কখনো? মানুষের জন্য নিরীহ প্রাণী হত্যা কতোটা গ্রহণযোগ্য? পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন কি তবে আদালতকেও গুরুত্ব দেয় না? জানি না শেষ পর্যন্ত এসবের বিচার হবে কিনা!

রামপুরার ঘটনায় মহামান্য আদালত যদি শেষ পর্যন্ত হত্যাকারীকে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন তবে এটি বাংলাদেশের প্রাণী সুরক্ষায় উন্মোচিত হবে নতুন এক দিগন্ত। যা প্রাণীপ্রেমি প্রত্যেকটি মানুষকে আগামীতে প্রাণী কল্যাণে সোচ্চার হতে ঐক্যবদ্ধ করবে নি:সন্দেহে। আশার কথা হচ্ছে, দেশের প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ আইন এতোটা শক্তিশালী না হলেও প্রাণী অধিকার কর্মীদের চেষ্টায় প্রথমবারের মতো রামপুরার কুকুরের মৃতদেহগুলো ময়না তদন্তের জন্য বঙ্গবাজারের কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। যা যেকোন প্রাণীর দেশ যে বাংলাদেশ তা প্রতিফলিত হয়েছে।

রামপুরার ঘটনায় সাধুবাদ দিতে হয় রামপুরা থানার পুলিশকে। বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রলয় দাদা তো রীতিমত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। কারণ একটাই যে, মানুষ নিষ্পাপ প্রাণী হত্যা করতে কার্পণ্য করে না, সে জঙ্গিবাদ বা মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করে না।

৪.
এক সময় মানুষের আশপাশে নানা প্রাণী ও বন্যপ্রাণীর বসবাস ছিল, তখন সাপ-বেজির লড়াই, রাতে শোনা যেত শিয়ালের কিংবা ঝিঝি পোকার ডাক।শহরগুলোতে এখন কুকুরের ডাক শোনা যায়। একদিন হয়তো তাও থাকবে না, যে গুটিকয়েক শিয়াল এখন দেখা মেলে হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর উল্লাসে তাও বিলুপ্তির মুখে। এই তো মাস দু’এক আগে নাটোরের সিংড়ার ইটালি ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে পিটিয়ে মারা হয়েছে একদল শিয়ালকে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে সাপ মারা হয়েছে। তবে কোন বিচার হয়নি এই নিষ্ঠুরতার। ফলে দিন দিন বেড়ে চলেছে মানুষের নিষ্ঠুর আস্পর্ধা।

 

৫.
শহরের রাস্তায় কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে টিকা দেয়াসহ বন্ধ্যাকরণ করা হচ্ছে। প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা তৈরির জন্য ক্যাম্পেইন করা হয়। দেয়া হয় রোগ প্রতিষেধক বিভিন্ন টিকা। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোন এলাকায় কুকুর জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে কামড় দিলে তা কিছু মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়। এতে সরকারের সংস্থাগুলো নিজেদের দায় এড়াতে ওই এলাকার সকল কুকুরকে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এতে পরিক্ষা করে দেখা হয় না, যে ভালো কুকুরটিও মারা যাচ্ছে কিনা! আর কুকুরের ব্যাপক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণই যদি গণহারে বিভিন্ন এলাকায় কুকুর মেরে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য হয় সেক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক।

৬.
এর শেষ কোথায়? নিরীহ পশুর ওপর কিসের এত ক্ষোভ? পাশবিকতা এই রুপ সমাজে মানুষের মানসিক বৈকলাঙ্গ’র প্রকাশ নয় কি? প্রকাশ্যে কুকুরের গণহত্যা চালানো হয় যা দেখে বিরূপ প্রভাব পড়ছে নানা বয়সীদের মনেও। তাই এখন সরকারকে এ বিষয়ে সবচে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে, প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৫ সালের খসড়াটি মজবুতভাবে প্রণয়ন এবং প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন ১৯২০ যথার্থভাবে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা। এই আইনের যৌক্তিক প্রণয়ন হলে নৃশংসভাবে প্রাণী হত্যার দায় এড়ানো কঠিন হবে। মানুষসহ সকল প্রাণীর জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র গঠন সরকারের ভূমিকাই এখন বেশি দরকার। তা না হলে এই ভয়াবহতা আরো প্রকট হবে।

পরিশেষে বলি, প্রাণীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আসুন প্রাণী সংরক্ষণে সোচ্চার হই। ঐক্যবদ্ধতায় অটুট থাকুক প্রাণী কল্যাণ আন্দোলন।

লেখক: আমিনুল ইসলাম মিঠু, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক

ad

পাঠকের মতামত