178479

ছাত্রীর স্পর্শকাতর স্থানে বাস শ্রমিকের ছোয়া, অতঃপর

‘গত সন্ধ্যায় আমি একটুর জন্য গ্যাং রেপড হওয়া থেকে বেঁচে গেছি। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বনানী থানার পুলিশদের। তারা সময় মতো না এলে নিশ্চিত আমাকে গ্যাং রেপড করতো।’ কথাগুলো যৌন হয়রানির শিকার এক তরুণীর। এই তরুণীর মতোই প্রতিনিয়ত নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ঢাকার নারীরা। শপিংমল-রাস্তায়-যানবাহনে জনসম্মুখে ঘটছে হয়রানির ঘটনা। যেন রাজধানীর পথে নিরাপত্তাহীন নারী।

বিষয়টি প্রকাশ পাচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। বলা হচ্ছে, নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানির দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ খারাপ শহর হচ্ছে ঢাকা। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের করা এক জরিপে এমনটিই প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে সুযোগ পেলেই নারীদের উদ্দেশ্যে নোংরা বাক্য ছুড়ে দেয়া হচ্ছে। কাছাকাছি পেলে স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়া হচ্ছে। জনসম্মুখে এ রকম ঘটনা ঘটলেও তেমন কেউ প্রতিবাদ করছেন না। তারপরও দৈনিক গড়ে চার থেকে পাঁচটি যৌন হয়রানি-নারী নির্যাতনের অভিযোগ আসছে পুলিশের কাছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যানুসারে গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৪৯টি। এ বছরের জানুয়ারিতে ৮৬, ফেব্রুয়ারিতে ৯২, মার্চে ১৩৪, এপ্রিলে ১০৮, মে মাসে ১৪৭, জুনে ১২৯, জুলাইয়ে ১২৯ ও আগস্টে ১৫৯টি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থানা-পুলিশমুখো হন না নির্যাতিতরা। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গত আগস্টে বনানীর কাকলিতে ঘটে ঘটনাটি। নির্যাতনের শিকার তানজিম নাঈমাহ নামের এক তরুণী। তিনি জানান, প্রতিদিনই মিরপুর-১০ থেকে বনানীতে টিউশনি করতে যান তিনি। ঘটনার দিনও বাসযোগে বনানীর সৈনিক ক্লাবের সামনে নামেন তিনি। সময় তখন সন্ধ্যা। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। পেছন থেকে এক যুবক তার শরীরে হাত দিয়ে জোরে চাপ দিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকে।

তানজিমও ছেড়ে দেয়ার মেয়ে নন। তিনিও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকেন। ততক্ষণে ওই যুবক রাস্তা পার হয়ে ওভার ব্রিজে উঠে গেছে। তানজিম চিৎকার করছিলেন, ‘ভাই, ওরে ধরেন।’ ওভারব্রিজের উপরে সাত-আট জন মিলে যুবককে আটকে রাখে। ততক্ষণে তানজিমও পৌঁছে যান সেখানে। তানজিমের ভাষায়, ‘আমি যখন ওই লোকের সামনে গিয়ে বললাম যে- সে আমার গায়ে হাত দিছে, তখন তারা বললো, ওহ, গায়ে হাত দিছে! মোবাইল নেয় নাই? আমরাতো ভাবছি মোবাইল টান দিছে, তাই ধরছি।’

তানজিম বলেন, তাদের কথায় মনে হলো গায়ে হাত দেয়া কোনও ঘটনাই না, একটা মেয়ে রাস্তায় বের হলে গায়ে হাত দেওয়াই যায়। তানজিম জানান, তার কাছে ছিলো পিপার সেপ্র। আত্মরক্ষার জন্যই এটি সঙ্গে রাখতেন। যৌন নির্যাতনকারী ওই যুবককে যখন ওরা ছেড়ে দিচ্ছিলো ঠিক তখনই ওই যুবকের চোখে পিপার সেপ্র করেন। তারপরই উল্টে যায় পুরো দৃশ্যপট।

সেপ্র করার পর যখন চোখ জ্বলতে শুরু করে তখনই তারা তানজিমকে মলমপার্টি মনে করে ঘিরে ধরলো। অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করলো। ওরা তার ওড়না ধরে টানছিলো। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলাতে থাকলো। কেউ চুলের মুঠি ধরে লাথি দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো। কেউ কেউ সেই দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলো। মলমপার্টি মনে করে এভাবেই নির্যাতন করা হচ্ছিলো তাকে। ওই সময়ে বনানী থানার টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের কবল থেকে রক্ষা করে তানজিমকে। তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে এ বিষয়ে কোনো মামলা করেননি তিনি।

তানজিম বলেন, উন্নত দেশগুলোতে মেয়েরা নিরাপত্তার জন্যই পিপার সেপ্র ব্যবহার করতেন। আমিও তা সঙ্গে রাখতাম। তবে পিপার সেপ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুলিশের অনুমতি লাগবে জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস বলেন, নতুবা এটা অপরাধীরাও ব্যবহার করতে পারে।

প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে গণপরিবহনে। ভুক্তভোগীরা জানান, বাস থেকে উঠানো-নামার সময় বাসের হেল্পার কর্তৃক হয়রানির শিকার হন নারীরা। এছাড়া যাত্রীদের মধ্য থেকেও নানাভাবে যৌন হয়রানি করা হয়। এ রকম একটি ঘটনা ঘটে গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে।

যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলীগামী আট নম্বর বাস থেকে ফার্মগেটে নামছিলেন এক ছাত্রী। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে হেল্পার। দরজার সামনে যাত্রীদের ভিড়। তারা বাসে উঠতে চাচ্ছেন। এর মধ্যেই নামেন ওই ছাত্রী। তখন ওই ছাত্রীর স্পর্শকাতর স্থানে ডান হাতে চেপে ধরেন বাসের হেল্পার। বিষয়টি নজরে পড়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবকের। তাৎক্ষণিকভাবে দুই যুবক এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন। তবে যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রী নিরবেই চলে যান।

মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুরাইয়া আমিন অভিযোগ করেন, প্রায়ই বাসে পুরুষদের পাশে বসে কর্মস্থলে যেতে হয় তাকে। মিরপুর থেকে মতিঝিলে যেতে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, বাস একটু ঝাঁকুনি দিলেই পাশের সিটের পুরুষটি গায়ের উপর এসে পড়েন।

রামপুরা থেকে নিয়মিত ধানমন্ডি যাতায়াতকারী এক নারী জানান, যাত্রী বেশি হওয়ায় প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, বাসে দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় পেছন থেকে তাকে চেপে দাঁড়ান চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী এক ব্যক্তি। ক্রমান্বয়ে তিনি আরও চাপতে থাকেন। তাকে সরে যেতে বলতেই চটে যান তিনি। উল্টো ওই নারীকে বলেন, সমস্যা হলে পাবলিক বাসে উঠেন ক্যান। প্রাইভেট গাড়িতে চড়েন।

ভুক্তভোগী নারীরা জানান, বাসে নামকাওয়াস্তে নারীদের সংরক্ষিত আসন। বাস্তবে শিশু, প্রতিবন্ধী ও নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৯ আসন লেখা থাকলেও সেখানে আগে থেকেই পুরুষরা বসে থাকতে দেখা যায়। শুধু বাসে না যৌন হয়রানির শিকার হতে রাস্তাঘাটে, শপিংমলে। কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে নিউ মার্কেটে শপিং করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হোন মধ্য বয়সী এক নারী।

তিনি জানান, গত বুধবার বলাকা সিনেমা হলের পাশে ভিড়ের মধ্যে শরীরে একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠেন তিনি। ফিরে তাকাতেই দেখেন অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। ভাবটা এ রকম যেন তিনি কিছুই জানেন না।

ইডেন কলেজের ছাত্রী মারিয়া জানান, তারা দুই বোন বেড়াতে গিয়েছিলেন সংসদ ভবন এলাকায়। ফেরার সময় প্রায় সন্ধ্যা। বেশ ক’জন যুবক তাদের টিজ করছিলো। একজন সরাসরি বাজে প্রস্তাব দিয়েছিলো। পরে দ্রুত তারা ওই স্থান ত্যাগ করেন।

এসব বিষয়ে ডিবি পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, যৌন হয়রানির বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ঢালাওভাবে যৌন হয়রানির দিক থেকে ঢাকা খুব খারাপ শহর এটা বলা ঠিক না। বিভিন্ন বাসে যৌন হয়রানি হতে পারে। কিন্তু তা প্রতিরোধে পুলিশ তৎপর। এমনকি সাদা পোশাকে গোয়েন্দারাও দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান তিনি।

এক কোটির বেশি মানুষ বসবাস করেন এমন ১৯টি শহরের ওপর এক জরিপ কার্যক্রম চালিয়েছে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন। ওই জরিপের ফল অনুযায়ী, নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহরের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানির দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ মহানগরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। সূত্র: মানবজমিন

ad

পাঠকের মতামত