178325

ওয়েব সিরিজের নামে এ কেমন যৌনতা আর অশ্লীলতা দেখুন

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে ওয়েব সিরিজ। মূলত টিভি মিডিয়ার বাইরে ইন্টারনেটে নাটক প্রচারের মাধ্যমকে ওয়েব সিরিজ বলে। এ মাধ্যমে নাটকের সেন্সর বলতে আপাতত কোনো কিছুই বাংলাদেশে নেই। এর ফলে যে যার মতো করে নাটক বানিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করছে। এতে দেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হচ্ছে কিংবা অশ্লীলতার তকমা লাগছে কিনা এসব নিয়ে লিখেছেন আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব।

ওয়েব সিরিজের নামে কী চলছে?
ওয়েব সিরিজ। নামটা খুব অপরিচিত ঠেকছে, তাই না? কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, ‘এটা আবার কী জিনিস?’ সহজ ভাষায়, শুধু অনলাইন বা অনলাইন টিভির জন্য তৈরি ও প্রকাশিত ধারাবাহিকের (ধারাবাহিক ভিডিও) নাম ওয়েব সিরিজ। সাধারণত ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ট্যাব ও স্মার্টফোনই এ ধরনের সিরিজ দেখার মাধ্যম। মূলত নব্বই দশকে আমেরিকায় এর জন্ম। বিশ শতকের শেষ দিকে উত্থান। একুশ শতকে এর বিশ্বভ্রমণ, বিনোদনের প্রভাবশালী বিকল্প মাধ্যম হয়ে ওঠা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর জয়যাত্রা শুরু অনেক আগে। তবে বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের মাত্র ঊষাকাল যাচ্ছে। আর ঊষাতেই বিতর্ক, সমালোচনা ও চায়ের টেবিলে ঝড়! তার আগে দেশীয় বিনোদনের এ নতুন মাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় পর্বটা সারা যাক।

ওয়েব সিরিজের ইতিহাস

নব্বই দশকে আমেরিকান লেখক ট্রেসি রিড লিখিত ‘কোয়ান্টামলিঙ্ক সিরিয়াল’ (১৯৮৮-৯৯) দিয়ে ওয়েব সিরিজের আত্মপ্রকাশ। এরপর স্কট জাকারিনের সৃষ্টি ‘দ্যা স্পট’ (The Spot)। ১৯৯৫-৯৭ সালে প্রচারিত এই সিরিজের জন্য এর প্রকাশনা সংস্থা ‘ইন্টারনেটের অস্কার’খ্যাত ‘Webby awards’ পুরস্কার পায়। মূলত এ সিরিজ দিয়েই এ ধারার জয়যাত্রা। তারপর অ্যানিমেটেড Bullseye Art, 1998 সালে কমেডি Stella Shorts, 2003 সালে Weird TV 2000, তারপর একে একে Red Vs. Blue, Sam Has 7 Friends, Bravo ইত্যাদি সিরিজ এ ধারাটিকে প্রচণ্ড জনপ্রিয় করে তোলে। তন্মধ্যে Sam Has 7 Friends সিরিজটি ২০০৬ সালের ‘ডে টাইম অ্যামি অ্যাওয়ার্ডে’র জন্য মনোনীত হয়।

তবে ওয়েব সিরিজকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করার পেছনে নেটফ্লিক্সের বেশ ভালো অবদান। ২০১৩ সালে নেটফ্লিক্সের ৩টি সিরিজ (House of Cards, Arrested Development I Hemlock Grove) প্রাইমটাইম অ্যামি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পায়। ২০১৬ সালে বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ Streamys, Webbys, Indie Series Awards, Emmy Awards, Canadian Screen Awards সহ বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়। বর্তমানে ওয়েব সিরিজকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে ২১টি আন্তর্জাতিক উৎসব ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে।

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজ

ঈদ উপলক্ষে বরাবরই অসংখ্য নাটক-টেলিফিল্ম-অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এতকাল সেটি ছিল টিভিকেন্দ্রিক। গত রোজার ঈদে ওই ধারায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হল অনলাইন। টিভির পাশাপাশি ওই সময় ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রকাশ পায়। তার মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে ৭ পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’; ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার পায় বিশেষ নাটক ‘উপহার’। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রকাশ পেল একাধিক নাটক। তন্মধ্যে সিএমভির ব্যানারে ৭ পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘দ্য লিস্ট’, ধ্রুব এন্টারটেইনমেন্টের ব্যানারে সাত পর্বের দুই সিরিজ ‘বাঘবন্দি’ ও ‘আবাসিক হোটেল’, কিংবা টয়া অভিনীত ‘পালাবি কোথায়’ উল্লেখযোগ্য।

কেন ওয়েব সিরিজ?

ট্রেন্ড বা ধারা বদলে বরাবরই তারুণ্যের রুচি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিনোদনের ক্ষেত্রে তারা এখন প্রবলভাবে টিভিবিমুখ এবং ইউটিউবমুখী। টিভির নাটক, অনুষ্ঠানই এখন জনপ্রিয় হচ্ছে ইউটিউবে। সময়ের আবর্তনে ইউটিউবের ভিউয়ারই হয়ে গেছে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি। আর গান তো এখন পুরোদস্তুর ইউটিউবনির্ভর। তো দর্শক আকর্ষণ বা জনপ্রিয়তার মাধ্যম যদি ইউটিউবই হয়, তবে কেন শুধু ইউটিউব বা অনলাইনের জন্য নাটক বা অনুষ্ঠান নয়? এ ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মূলত বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের উদ্যোগ। তা ছাড়া বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, তরুণ জনপ্রিয় নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংযুক্তি; ওয়েব সিরিজের সম্ভাবনাকে বেশ ভালোভাবে জাগিয়ে তুলেছে।

ওয়েব সিরিজ নিয়ে বিতর্কটা যেখানে

আলোচনা বা প্রশংসা নয়, সমালোচনা ও বিতর্ক দিয়েই বাংলাদেশে ‘ওয়েব সিরিজ’-এর জনযাত্রা। ইতিবাচকতা নয়, নেতিবাচকতা দিয়েই ওয়েব সিরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ। এমনকি কপালে জনপ্রিয়তার তকমা সাঁটার আগেই সেঁটে গেছে যৌনতা, অশ্লীলতার তকমা। গত ঈদুল আজহায় প্রচারিত ‘দ্য লিস্ট’, ‘বাঘবন্দি’ ‘পালাবি কোথায়’ প্রভৃতি ওয়েব সিরিজে অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক যৌনতার সুড়সুড়ি, অশালীন সংলাপ ও অঙ্গভঙ্গি, মাদক গ্রহণের দৃশ্যবালীর কারণেই মূলত এই সমালোচনা। বিষয়বস্তু বা শিল্পগুণের বদলে ‘অকাক্সিক্ষত’ দৃশ্যের বন্দুকে সস্তা ও দ্রুত জনপ্রিয়তা বা বিপুল ভিউয়ার শিকারের চেষ্টা, নাটকগুলোতে খুব দৃষ্টিকটুভাবে পরিলক্ষিত হয়।

অশ্লীলতা বনাম আইন

অশ্লীলতা মাত্রই কেবল নিন্দনীয় নয়, একই সঙ্গে দণ্ডনীয়। ওয়েব সিরিজের কিছু ভিডিওতে যৌনতার যে দৃষ্টিকটু বাণিজ্যিক সমীকরণ বা অশ্লীলতার যে স্যাঁতসেঁতে ব্যাকরণ ধরা পড়ে, তা প্রচলিত একাধিক আইনে অপরাধ। যেমন-

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (২০১৩ সালে সংশোধিত) : ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রুনিক বিন্যাসে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু প্রকাশ করে যা অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে; তবে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন (ধারা-৫৭)।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১

টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কেউ অশ্লীল বার্তা প্রেরণ করলে তাকে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৫ কোটি অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে (ধারা-৬৯)।

পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ : এখানে ‘পর্নোগ্রাফি’ মানে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য; যা চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। এ সংজ্ঞামতে, যৌন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গিও ‘পর্নোগ্রাফি’র কাতারে পড়ে, যার সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড [ধারা-২, ৮(৩)]। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬-এও একই ধাঁচের বিধান থাকছে। যৌন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি বা ভিডিওচিত্রকে এই আইনে নাম দেয়া হয়েছে ‘ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি’, যার সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়ই (ধারা-১৮)।

উল্লেখ্য, ১৭ সেপ্টেম্বর পর্নোগ্রাফির অভিযোগে ‘নেশা’ নামক এক মিউজিক ভিডিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত ৭ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে পর্নোগ্রাফি মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার নাজমুল আহসান। এ ধরনের মামলা বাংলাদেশে এই প্রথম। যাত্রায় ওয়েব সিরিজে যা শুরু হয়েছে, তাতে আগামীতে এ ধরনের মামলার পুনরাবৃত্তি হলে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

সংকটের কার্যকারণ ও সমাধান রেখা

টিভিতে প্রচারিত নাটকগুলো নির্মাতা সরাসরি দেখাতে পারে না। তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। ছবির ক্ষেত্রেও একইভাবে আছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র। কিন্তু শুধু অনলাইনে গান বা ভিডিও প্রকাশে এ ধরনের অনুমোদন বা সেন্সরশিপের ব্যবস্থা নেই। নির্মাতারা এ ক্ষেত্রে বনের পাখির মতো নিরঙ্কুশ স্বাধীন। আর স্বাধীনতা যেখানে অবারিত, অপব্যবহার সেখানে অবধারিত। তাই ওয়েব সিরিজের অরাজকতা বা অশ্লীলতা ঠেকাতে চাইলে, এখানেও এক ধরনের সেন্সরশিপ সিস্টেম রাখা দরকার। তজ্জন্য সংস্কৃতি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ে ‘অনলাইন কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ কমিটি’ নামে কমিটি চালু করা যেতে পারে। অনলাইনে কোনো ভিডিও ছাড়ার আগে এ কমিটিতে জমা দিতে হবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে অশ্লীলতা, মানহানি, ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কনটেন্টের বিষয়টা খতিয়ে দেখবে। তাদের অনাপত্তি পেলেই কেবল ভিডিওটি অনলাইনে ছাড়া যাবে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসিতেও এ ধরনের একটা সেল থাকতে পারে। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও বিষয়টি নজরদারি করতে পারে।

অস্বীকারের জো নেই, ওয়েব সিরিজ বিনোদনের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটা মাধ্যম। তবে বাংলাদেশে এখনও এ ধারা হাঁটি হাঁটি পা পা দশা। যুগের চাহিদায় ও সময়ের স্রোতে এখানেও ধারাটি আগামীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সৃজনশীল শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চায় বিশ্বাসী। তাই চাই, ওয়েব সিরিজ এ দেশে সৃষ্টিশীলতার সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক। কিন্তু শিশুকালেই ধারাটি যে আতঙ্কের বীজ ছড়াল, অশুভ বার্তা দিল- তা কোনোভাবে প্রত্যাশিত ও সমর্থনীয় নয়। তাই ওয়েব সিরিজের চারাটি পরিশুদ্ধ হয়ে, কলঙ্ক বা আগাছামুক্ত হয়ে এ দেশে বেড়ে উঠুক। প্রতিষ্ঠা পাক, প্রকৃত ও মুক্তমনা শিল্পচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট পাদপীঠ হিসেবে।

লেখক : আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ad

পাঠকের মতামত