মা-বাবা একি করেন! তাহলে সন্তানের আর দোষ কী?
সারাক্ষণ অভিযোগের ঝুলি খোলা থাকে মা-বাবার। সন্তান এ করছে না, সে করছে না। ‘ওকে নিয়ে পারছি না—মোবাইলে মুখে গুঁজে থাকে’, ‘ফেসুবকের জন্যই তো রেজাল্ট খারাপ হলো’। একই বাড়িতে আবার উল্টো দৃশ্যও দেখা যাবে। মা-বাবা শুধু সন্তানের ভুল ধরেন কিন্তু নিজেরা যে অনলাইনে থাকেন, তার খেয়াল কে রাখে? ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯ ঘণ্টাই তাঁরা গ্যাজেটের সঙ্গে বাস করেন। ভার্চ্যুয়াল জগতের নীল পর্দা তাঁদের টানে। মা-বাবাই যদি এমন করে থাকেন, তাহলে সন্তানের আর দোষ কী? সন্তান তো বেশির ভাগ শিক্ষা পরিবার থেকে পায়।
টাইম ম্যাগাজিনে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সন্তানের মনোবিকাশ নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কমন সেন্স। তারা এই গবেষণা পরিচালনা করে। ৪০ বছর বয়সী ১ হাজার ৭৮৬ জন মা-বাবার মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়। ৩৫ শতাংশ মা-বাবা মনে করেন, স্মার্টফোন বা নিত্যনতুন প্রযুক্তি তাঁদের প্যারেন্টিংকে সহজ করেছে। মাইকেল রব ছিলেন এই গবেষণার পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমরা চাইনি, মা-বাবা অপরাধবোধে ভুগতে থাকুক; বরং তাঁরা আরও বেশি সচেতন হবেন—এমনটাই আশা করেছি।’
মা-বাবা কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, বাড়ি ফিরেও তাঁরা কমবেশি সময় কাটান প্রায় নয় ঘণ্টা। দেখা গেছে, এর মধ্যে মাত্র দেড় ঘণ্টা তাঁরা সত্যিকার অর্থে কাজ করেন। বাকি সময়টুকুতে মেসেজ পাঠানো, গেমস খেলা, নানা রকম অনুষ্ঠান দেখা, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা, সুযোগ পেলে একটু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঢুঁ মারা—সেসব তো আছেই।
অফিসের কাজের ফাঁকে তাঁরা এগুলো করে থাকেন। স্বল্প আয়সম্পন্ন এবং স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়েরা বেশির ভাগ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সিনেমা, মিউজিক ভিডিওসহ নানা রকমের ভিডিও তাঁরা দেখেন। ৪৮ শতাংশ মা-বাবা কর্মক্ষেত্রে বার্তা লেখেন, ৩৮ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন, ৩৩ শতাংশ টিভি দেখেন। দুই-তৃতীয়াংশ মনে করেন, প্রযুক্তির প্রতি এই আসক্তি তাঁদের কাজের বিঘ্ন ঘটায় না। আর ৭৮ শতাংশ বলেন, প্রযুক্তিপণ্য ভবিষ্যতে তাঁদের সন্তানদের জীবনে সুফল আনবে। অনেকটা আদর্শের প্রতীক হয়ে উঠবে।
বেশ কিছু কম বয়সী মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, প্রযুক্তি কীভাবে তাঁদের জীবনে প্রভাব ফেলছে, কতটুকু সময় তাঁরা এর পেছনে ব্যয় করেন। প্রশ্নটা তাঁদের জন্য বিস্ময়কর ছিল। তাঁরা এ বিষয়ে কখনো ভাবেননি। কিন্তু পারিবারিক জীবনে সম্পর্ক জটিল হলো কি না, সে বিষয়ে তাঁরা আবার সচেতন। প্রযুক্তি যে এখানে প্রভাব ফেলতে পারে, সেই উপলব্ধি তাঁদের মধ্যে হয়নি।
আবার এই বাবা-মায়েরাই চিন্তিত যে প্রযুক্তির কারণে তাঁদের ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবা এটাও ভাবেন, ‘টেক স্যাভি’ হলে সন্তান বড় হয়ে ভালো চাকরি পাবে। এগিয়ে থাকবে অন্যদের থেকে। অপরদিকে মা-বাবা চান, সন্তানেরা নির্দিষ্ট কিছু সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করুক। সেই মা-বাবার নিজের মোবাইলে ‘বিপ’ বা ‘টুং’ কোনো শব্দ হলেও তাঁরা অস্থির হয়ে ওঠেন। মা-বাবারই যদি এই অবস্থা হয়, সন্তানের আর দোষ কী।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ হেলালের মতে, সন্তান যা করে, পরিবারের সেখানে সবচেয়ে বড় প্রভাব থাকে। মা-বাবা ঝগড়া করলে যেমন তার নেতিবাচক প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ে, আবার প্রযুক্তিতে আসক্ত হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে সন্তানের ওপর। নিজের বদ-অভ্যাস আগে ঠিক করতে হবে। মা-বাবা কোনো ভুল করছেন কি না, সেই উপলব্ধি সবার আগে আসতে হবে। তা না হলে সন্তানকে ভালো কিছু শেখানো কঠিন হয়ে যাবে।