পরীক্ষায় প্রথম হয়েও ঘুষের কাছে হার
বেলাল হোসেন (২২)। যশোর এমএম কলেজের স্নাতক (সম্মান) ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
সংসারে অভাব তাড়াতে মণিরামপুর উপজেলার শাহ আলী সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদরাসায় নৈশপ্রহরী পদে চাকরির আবেদন করেন। অষ্টম শ্রেণি পাসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে তিনি প্রথম হন। কিন্তু ঘুষ বাণিজ্যের কাছে হেরে যাচ্ছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাঁচাকড়ি এলাকার শাহ আলী সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদরাসার নৈশপ্রহরী অবসরে যাওয়ায় পদটি শূন্য হয়। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ওই পদে লোক নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করেন এলাকার পীর মোহাম্মদ ফকিরের ছেলে মেধাবী ছাত্র বেলাল। ২০ এপ্রিল নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র পান। ২৮ এপ্রিল বিকেল ৩টায় যশোরের খালদা রোডের আমিনিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসায় লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯ জনের মধ্যে প্রথম হন বেলাল।
বেলাল বলেন, ‘ওই দিন প্রথমে একবার প্রশ্ন দেওয়া হয়। তখন আমার লেখা দেখে এবং মনোনীত প্রার্থীর লেখা খারাপ দেখে সভাপতি পরীক্ষা বাতিল করে দেন। পরে আবার নতুন প্রশ্নে পরীক্ষা হয়। তাতেও আমি প্রথম হই। তারপর মহাপরিচালক (ডিজি) প্রতিনিধিসহ সবাই আমার নাম সুপারিশ করে নিয়োগ দিতে বলেন। ’
বেলাল জানান, নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন পর তিনি পাঁচাকড়ি নতুন বাজারে মাদরাসা সুপারের সঙ্গে দেখা করেন। কবে ওই পদে নিয়োগ হবে জানতে চাইলে সুপার বলেন, ‘সময় হলে ডেকে নেওয়া হবে। ’ তখন সুপার তাঁকে জানান, কমিটি ও শিক্ষকরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে-ই চাকরি করতে আসুক না কেন তাঁকে ১২ লাখ টাকা দিতে হবে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য জিয়াউর রহমান তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা চেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন বেলাল।
বেলাল গরিব পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবার মাত্র ৪ শতাংশ জমির ওপর জরাজীর্ণ একটি ঘর। এ ছাড়া সহায়-সম্বল বলতে আর কিছু নেই। বাবা পীর মোহাম্মদ ফকির অসুস্থ। ঠিকমতো কাজে যেতে পারেন না। ফলে বেলালকে মাঠে কাজ করে সংসার ও লেখাপড়া দুটোই চালাতে হয়। তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। স্নাতক দুই সেমিস্টারে তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সংসারে অভাব থাকায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে অন্যের জমিতে কাজ করছেন। যেদিন নিয়োগ পরীক্ষা ছিল, সেদিনও অন্যের জমিতে কাজ করে পরে পরীক্ষা দিতে গেছেন বেলাল।
বেলাল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মেধাবী হয়েও সংসারের অসচ্ছলতায় নিজেকে সেইভাবে গড়তে পারিনি। ভেবেছিলাম, চাকরিটা পেলে সংসার খরচের পাশাপাশি লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারব। কিন্তু সভাপতির ঘুষ বাণিজ্যের কাছে আমার স্বপ্ন বিলীন হচ্ছে। ফলে হতাশা গ্রাস করছে আমাকে। ’
বেলালের চাচা নুর ইসলাম ফকির ওই মাদরাসার সাবেক সদস্য। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সভাপতি রফিকুল একজনকে চাকরি দেবেন বলে ১১ লাখ টাকা দাবি করে আট লাখ টাকায় রফা করেছেন। প্রার্থী জসিমের কাছ থেকে সভাপতি এরই মধ্যে চার লাখ টাকা নিয়েছেনও। ’ ফলে এই নিয়োগ বোর্ড বাতিল করে পুনরায় বোর্ড বসিয়ে সভাপতি জসিমকে চাকরি দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। অথচ জসিম নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তৃতীয় হয়েছেন।
জানতে চাইলে নিয়োগ বোর্ডের ডিজি প্রতিনিধি ইমন আমীর বলেন, ‘আমরা নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারি মাত্র। নিয়োগ দেওয়ার কাজ কমিটির। ’ তিনি এ ব্যাপারে বোর্ডের পরিচালক বরাবর আবেদনের পরামর্শ দিয়েছেন।
মাদরাসার সুপার আব্দুস সালাম বলেন, ‘৩০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২১ পেয়ে বেলাল প্রথম হয়েছেন। কিন্তু নিয়োগের বিষয়ে আমার হাত নেই, ওটা সভাপতির। এ ছাড়া টাকা-পয়সার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। ’
এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মোড়লের মোবাইল ফোনে গতকাল শুক্রবার বিকেলে কালের কণ্ঠ অফিস থেকে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয়রা জানায়, রফিকুল নাশকতাসহ কয়েকটি মামলার আসামি। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন।
সূত্র: কালের কন্ঠ