আমাদের অনেক এমপি অত্যাচারী, অসৎ : অর্থমন্ত্রী
ডেস্ক রিপোর্ট : যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে গত ১১ থেকে ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের কার্যালয়ে ১৫ অক্টোবর তিনি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রথম আলোকে দেয়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকারটি আমাদের সময় ডট কমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আগামী নির্বাচন
প্রশ্ন: শুরু করি রাজনীতি নিয়েই। আগামী বছরই তো নির্বাচন। কিছু বলবেন?
অর্থমন্ত্রী: আমি খুবই আশাবাদী যে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি অংশ না নিলেও তাঁর দলের অন্যরা অংশ নেবেন। মনে হয় না তাঁর দলের অন্যরা অংশ না নেওয়ার মতো অত বোকার কাজ করবেন। অংশ নেওয়াটাই ভালো হবে। তখন একটা প্রতিযোগিতা হবে। প্রতিযোগিতা হলেই আমাদের অনেক এমপিকে পাস করতে বেগ পেতে হবে। কারণ, আমাদের অনেক এমপি অত্যাচারী, অসৎ। তাঁরা মানুষের কাছ থেকে নানা ধরনের টাকাপয়সা আদায় করেন। একে ঠিক ঘুষ বলব না।
প্রশ্ন: সবাই এ কাজ করেন?
অর্থমন্ত্রী: বেশ অনেকজন। সংখ্যাটা কম না। আমিই জানি কয়েকজনের কথা। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হলে তাঁরা তখন শিক্ষা পাবেন। ভালোই শিক্ষা পাবেন।
প্রশ্ন: শিক্ষাটা তখনই পাবেন? তার আগে নয়?
অর্থমন্ত্রী: তার আগেও পাবেন। নেত্রী নিজেও খোঁজ-খবর রাখছেন। তাঁদের অনেকেই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। আমার মনে হয় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে অনেক নতুন মুখ আসবে।
প্রশ্ন: কোনো কোনো এমপির মধ্যে এমন মনোভাবও আছে বলে শোনা যায়—‘আমি কি তোমাদের ভোটে এমপি হয়েছি? তোমাদের প্রতি আবার জবাবদিহি কী?’
অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন কয়েকজনকে।
ব্যাংক খাত
প্রশ্ন: আরকেটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। এই খাত তো ভালো চলছে না। ব্যাংক খাতে তো একশ্রেণির লোক ব্যাপক লুটপাটও করছে।
অর্থমন্ত্রী: কথা ঠিক। ব্যাংক খাত তেমন ভালো চলছে না। আমাদের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। কিছু কিছু লুটপাট বেসরকারি ব্যাংকেও দেখা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারটা খুব বেশি। কারণও আছে। সরকারি ব্যাংকগুলো কিছু অর্থায়ন করে সরকারের অনুরোধে বা দিকনির্দেশনায়। এগুলোর আদায় পরিস্থিতি খারাপ।
প্রশ্ন: আপনার কাছেও ধরা পড়েছে যে ব্যাংক খাত তেমন ভালো চলছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাহলে কী করছে?
অর্থমন্ত্রী: সরকারি ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম। বেশি নিয়ন্ত্রণ সরকারের। সরকারের নিয়ন্ত্রণ অবশ্য কমানোর চিন্তা আছে। তিন বা পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করছি। এটা ঠিক যে কয়েক বছরে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও খেলাপি সংস্কৃতির ব্যাপারে তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠেনি।
প্রশ্ন: সমালোচনা রয়েছে যে সব ব্যাংকের ওপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমান নিয়ন্ত্রণ বা দায়িত্ব থাকা দরকার। বৈশ্বিক চর্চাটাও এ রকম।
অর্থমন্ত্রী: সমালোচনাটা ঠিকই আছে। মানছি। কিন্তু পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিলে কিছু ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে।
প্রশ্ন: বাস্তবে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া ছাড়া কি সরকারি ব্যাংক নিয়ে সরকারের কোনো কাজ আছে? এখন তো তা-ও নিয়োগ দেয় পর্ষদ। সরকার খালি পছন্দ করে।
অর্থমন্ত্রী: না, না, না। পরিচালক নিয়োগ করে সরকারই।
প্রশ্ন: ঋণে অনিয়ম তো আর সরকার দেখে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ।
অর্থমন্ত্রী: এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিটা আরও শক্ত হওয়া উচিত। এই যেমন এসআইবিএলে (সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক) কয়েকজন পরিচালক অনাচার করছেন। এক দিনের ব্যবধানে ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার পরিবর্তন—এটা অপ্রত্যাশিত। গভর্নর ফজলে কবিরকে বলেছি তাঁদের আচ্ছা করে শাস্তি দিতে।
ঘুষ-দুর্নীতি
প্রশ্ন: ঘুষ ও দুর্নীত নিয়েও তো অভিযোগ আছে অনেক। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হয়েছে, তা তো স্বীকার করবেন।
অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ, ঘুষ-দুর্নীতি আছে…কম না।
প্রশ্ন: কমিয়ে আনার উপায় কী? দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর নির্ভর করা? রাজনৈতিক সদিচ্ছা কি কোনো উপায়?
অর্থমন্ত্রী: এক দুদক দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা তো লাগবেই। বর্তমান সরকারের তা আছেও। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হতে পারে দুর্নীতি কমানোর একটা ভালো সহায়ক শক্তি। আমি আবারও সিলেটের মদনমোহন কলেজের উদাহরণটি সামনে আনতে পারি। কলেজটার আয় দেখানো হতো বছরে ৮ লাখ টাকা। অনলাইন পদ্ধতি চালুর পর আয় বেড়ে দাঁড়াল ৮১ লাখ টাকা।
প্রশ্ন: আপনি একসময় গুরুত্বপূর্ণ আমলা ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে আছেন অনেক বছর। কোনো কাজ আদায় করে নিতে আপনাকে কেউ ঘুষ দিতে চায়নি?
অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ (হাসি)। ১৯৬২ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন দপ্তরের ৩ কোটি টাকার একটা কাজ। আল ফারুক নামের একটা কোম্পানি ছিল। টাকাটা যখন ওই কোম্পানিকে বরাদ্দ দিতে যাচ্ছি, তখন জাপানি একটা পার্টির লোক এলেন। কাজটির ব্যাপারে জাপানি পার্টির সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। জাপানি পার্টির লোক এসে আমাদের কমিটির চেয়ারম্যান জনাব রশিদকে একটা স্লিপ দিলেন যে তুমি যদি কাজটা দাও, তোমাদের জন্য ভালো একটা ভাগ থাকবে। আমি যেহেতু কমিটির সদস্য, সে হিসেবে আমারও ভাগের প্রশ্ন রয়েছে এতে। এটা হচ্ছে সরাসরি অফার।
প্রশ্ন: আর কোনো ঘটনা?
অর্থমন্ত্রী: আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে আমার এক সাবেক বসের সঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি এবং তিনিও আমাকে ঘুষ সেধেছিলেন। ১৯৬৭ সাল। তিনি কিছু পণ্য আমদানি করতে চেয়েছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে। কিন্তু আমরা তাঁকে অনুমতি দিচ্ছিলাম না। কাজটির ব্যাপারে দুইটা পার্টি ছিল তখন। একটা আইয়ুব খান বলয়ের, আরেকটা ইয়াহিয়া খান বলয়ের। তিনি একটা বলয়ে ছিলেন। তিনি এসে আমাকে বললেন, তুমি যদি কাজটা করে দাও তাহলে তোমার ভাইকে একটা কাজ দেব। তারপর এ ধরনের ঘুষ কেউ সাধতে আসেনি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ আমল বা গত ৮-১০ বছরের কোনো অভিজ্ঞতা?
অর্থমন্ত্রী: না। কেউই সেই দুঃসাহস দেখায়নি।
অর্থনীতি ও বাজেট
প্রশ্ন: এবার অর্থনীতি প্রসঙ্গে আসি। কেমন আছে দেশের অর্থনীতি?
অর্থমন্ত্রী: ঠিক এই মুহূর্তে অবস্থা খুবই সংকটপূর্ণ। তার কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারের মতো একটা দুষ্ট রাষ্ট্র আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদের লাখ লাখ লোককে আমাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। আর আমাদের মনোভাব হচ্ছে, কোনো আশ্রয়প্রার্থীকে আমরা আশ্রয় না দিয়ে পারি না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও তো এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক দিকটা খুবই শক্তিশালী। তবে কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের জন্য এখন আমাদের কোটি কোটি টাকা লাগবে। দেশে ফিরেই আমি বাজেট সংশোধনে হাত দেব।
প্রশ্ন: একেবারে বাজেট সংশোধনের মতো পরিস্থিতি হয়ে গেল?
অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। সবচেয়ে বেশি কাটছাঁট করতে হবে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি)। রাজস্ব বাজেট তো আর কাটছাঁট করা যায় না। রাজস্ব বাজেটের আকার বরং মিয়ানমারের কারণে বাড়বে। কারণ, সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হয়েছে। এ জন্য যে বাড়তি খরচ, তা বাজেট থেকেই যাবে।
প্রশ্ন: খরচের সংস্থান আসবে কোথা থেকে? রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি তো তেমন ভালো না।
অর্থমন্ত্রী: আমি তো আগেই বলেছি, এ বছর আমার লক্ষ্য হচ্ছে আয়কর থেকে বেশি রাজস্ব সংগ্রহ।
প্রশ্ন: নতুন মূসক (মূল্য সংযোজন কর) আইন কার্যকর করতে না পেরেই কি আয়করের দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন?
অর্থমন্ত্রী: না, না। মূসক আইন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তো হয়েছে। এটা হবে। কিছু কিছু তো বাস্তবায়ন করছিও। এবার তো মূসক থেকেও রাজস্ব আদায় আগের চেয়ে অনেক বেশি হবে। একটা উদাহরণ যদি দিই—টার্নওভার কর আগে ছিল ৪ শতাংশ, বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ শতাংশ। আয়কর থেকে আদায়টা শুধু বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে আয়করে আমি খুবই আশাবাদী।
প্রশ্ন: আয়কর দেওয়ার মতো যত লোক আছে দেশে, সরকার তাদের কাছ থেকে তা আদায় করতে পারে না কেন? সমস্যাটা কোথায়?
অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে আয়কর দেয় মাত্র ৭ লাখ মানুষ। এখন যদিও একটা ভদ্র সংখ্যা হয়েছে, ৩৩ লাখ।
প্রশ্ন: সরকারের টাকার দরকার, আবার আয়কর দেওয়ার সক্ষম লোকও আছে। অথচ সরকার তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। এটাও তো একধরনের ব্যর্থতা।
অর্থমন্ত্রী: ব্যর্থতা ঠিক, কিন্তু কাজটা সহজ নয়। প্রায় সব দেশের মানুষেরই আয়কর না দেওয়ার প্রবণতা আছে। খালি ফাঁকি দিতে চায়। আর আমাদের দেশে তো আয়কর দেওয়ারই সংস্কৃতি নেই, ফাঁকি তো পরের কথা।
প্রশ্ন: সরকার এমন পদ্ধতি বের করুক, যাতে ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়।
অর্থমন্ত্রী: আশার কথা যে নতুন প্রজন্ম আয়কর দিতে উদ্যোগী হয়েছে। কর মেলাটেলা করে কাজ হচ্ছে। তবে একটা সম্মানজনক জায়গায় যেতে সময় লাগবে। আমাদের এখন অন্তত এক কোটি করদাতা হওয়া উচিত। আশা করছি ২০২১ সালের মধ্যে এটা হয়ে যাবে। তাতে সরকারের আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাড়বে।
প্রশ্ন: স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ নিতে না পারার ব্যর্থতাকে কীভাবে দেখবেন?
অর্থমন্ত্রী: না, না, না। কে বলেছে স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারি না? ঋণ আমরা ব্যবহার করতে পারি না। ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাইপলাইনে পড়ে আছে। পুরো ব্যবহার করতে না পারার দুর্বলতা আমাদেরই।
প্রশ্ন : দুর্বলতার কারণ চিহ্নিত করেছেন?
অর্থমন্ত্রী: করেছি। প্রথম কারণ হচ্ছে প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হয়ে যায়। অনেক প্রকল্পের জন্য টাকা রাখা হয়, কিন্তু প্রকল্পটা আর হয় না।
প্রশ্ন: সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই এ ব্যাপারে?
অর্থমন্ত্রী: আছে। বলা আছে, প্রতিটি প্রকল্পের জন্য একজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) থাকবেন। এটাও কার্যকর হয় না।
সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অর্থমন্ত্রী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো থেকে নেয়া