কতটা সত্য বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’?
ভার্চুয়াল দুনিয়ার এক আতংকের নাম ‘ব্লু হোয়েল’। কয়েক মাস ধরে ভারতে ‘ব্লু হোয়েল’ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে। আর গত সপ্তাহে বাংলাদেশে সংবাদের শিরোনাম হয় ‘ব্লু হোয়েল’।
‘ব্লু হোয়েল’র কিউরেটরের নির্দেশে গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের বাসায় অপূর্বা বর্মণ স্বর্ণা (১৩) নামের এক কিশোরীর আত্মহত্যার খবর ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি।
কিন্তু এ ঘটনার পর নানা মহল থেকে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকে বাংলাদেশে ব্লু হোয়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। অনেকে ব্লু হোয়েলের লিংক খোঁজা শুরু করে।
সেন্ট্রাল রোডের ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্লু হোয়েল আক্রান্ত হওয়ার কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
ব্লু হোয়েল বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে বাংলাদেশে ব্লু হোয়েলে আসক্ত হওয়ার কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত কোনো কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। ফলে এ নিয়ে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
ব্লু হোয়েল গেম কীভাবে কাজ করে?
এটি অনলাইনভিত্তিক একটি গেম। অনলাইনে একটি কমিউনিটি তৈরি করে চলে এ প্রতিযোগিতা। এতে সর্বমোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। আর ধাপগুলো খেলার জন্য ওই কমিউনিটির অ্যাডমিন বা পরিচালক খেলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেবে। আর প্রতিযোগী সে চ্যালেঞ্জ পূরণ করে তার ছবি আপলোড করবে। শুরুতে মোটামুটি সহজ এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং কাজ দেয়া হয়। যেমন- মধ্যরাতে ভূতের সিনেমা দেখা। খুব সকালে ছাদের কিনারা দিয়ে হাঁটা এবং ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা ইত্যাদি।
তবে ধাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন ও মারাত্মক সব চ্যালেঞ্জ দেয় পরিচালক। যেগুলো অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এ খেলার সর্বশেষ ধাপ হলো আত্মহত্যা করা। অর্থাৎ গেম শেষ করতে হলে প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হবে। তবে এই গেমের শেষ ধাপে যাওয়ার আগেই খেলোয়াড়ের মৃত্যু হতে পারে। যেমন- ছাদের কিনারায় হাঁটা বা রেললাইনে হাঁটার মতো যেসব কাজ করতে বলা হয়, ওইসব কাজ করার সময় মৃত্যু হতে পারে।
গেমটির বেশিরভাগ ধাপই এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, ওইসব ধাপ অতিক্রম করতে করতেই খেলোয়াড়ের মৃত্যু হতে পারে। ব্লু হোয়েলের কবলে পড়ে ৫০তম ধাপে গিয়ে যারা আত্মহত্যা করছে কেবল তাদের খবরই প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু এর আগে যারা মারা যাচ্ছে তারা ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে মারা যাচ্ছে কিনা- তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
কীভাবে ব্লু হোয়েলে আসক্ত হয়?
ফিলিপ বুদেকিন নামে এক রুশ তরুণের তৈরি এ অনলাইন গেমটি ইন্টারনেটে প্রকাশ্য কোনো ওয়েবসাইটে (পাবলিক ডোমেইন) পাওয়া যায় না। কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ স্টোরেও থাকে না। ব্লু হোয়েল এর কিউরেটররা যাদের পছন্দ করে তাদের সামাজিকমাধ্যমে লিংক পাঠান। সেটি ইনস্টল করলেই কেবল ব্লু হোয়েলের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা যায়।
বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’ কতটা সত্য?
ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. আমিনুল হাকিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই গেম কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ স্টোরে থাকে না। কারও কাছ থেকে পাওয়া ওয়েবসাইটের ঠিকানা (লিংক) থেকে গেমটি নামিয়ে (ডাউনলোড) নিয়ে খেলতে হয়। বাংলাদেশে কোনো নেটওয়ার্কে এখনও ব্লু হোয়েলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।’
তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক অভিভাবক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এমনকি গেমটির ২১-২০তম পর্যায়ে আছেন দাবি করেও কেউ কেউ বেরিয়ে আসার পথ জানতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন’।
তিনি বলেন, ‘আমি গেমটি সম্পর্কে যা জেনেছি তাতে এটি একটি অনলাইনে নির্দেশনামূলক গেম৷ প্রতিটি স্তর পার হতে হয় নির্দেশনা মতো৷ আর সেই কাজের ছবি আপ করতে বলা হয়৷ এক তরুণ আমাকে বলেছে তাকে ঠোঁট সেলাই করতে বলা হয়৷ আর তার ছবি আপ করতে বলা হয়৷ ছবি আপ করলেই তাকে পরবর্তী স্তরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে৷ এই পর্যায়ে সে গেমটি ত্যাগ করে৷ জেনেছি ৫০তম স্তরে আত্মহত্যার মাধ্যমে এই গেম শেষ হয়৷’
ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই গেমের নেপথ্যে যারা কাজ করে তারা হতাশা এবং হিরো ইজমকে ব্যবহার করে৷ আর ধীরে ধীরে আত্মহননের পথে নিয়ে যায়৷ এটা মোটেই অসম্ভব নয়৷ মানুষের মানসিক অবস্থাকে ব্যবহার করতে পারলে তাকে দিয়ে অনেক কিছুই করানো সম্ভব৷’
সেন্ট্রাল রোডে আত্মহত্যা করা কিশোরীর বাবা অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মণ নিজেই ব্লু হোয়েল গেমের কথা বলেছেন৷ তিনি ঢাকার সাংবাদিকের কাছে বলেন, ‘স্বর্ণা কয়েক বছর ধরে কম্পিউটার ও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করছিল৷ প্যারা, রচনাসহ বিভিন্ন বিষয় ডাউনলোড করে পড়ত, ব্যবহার করতো ফেসবুক৷ কিছুদিন আগে আমাদের মনে সন্দেহ জাগে৷ গত পনের দিন আগে আমি তার মোবাইল চেক করলে সে অভিমান করে৷ মনে হয়েছে, আমি তার কক্ষে ঢোকার আগেই হয়তো সে কিছু গোপন জিনিস ডিলিট বা সরিয়ে ফেলেছে৷ তখন তাকে মোবাইলে একটি প্যারা পড়তে দেখি৷ আত্মহত্যা নির্বিঘ্ন করতে আগেই সে পরিকল্পনা করে৷ চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গত বুধবার বাসায় ফেরার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইনসুলিন নেয়ার আগে সে আমাকে একটি ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়৷ তার কক্ষে এসি থাকায় আমি তার কক্ষে শুয়ে পড়ি৷ তাকে তার মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের কক্ষে ঘুমাতে বলি৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখে ঘুম চলে আসে৷ রাত একটার দিকে সে আমাকে জাগিয়ে নিজের কক্ষে যেতে বললে আমি ঘুম ঘুম চোখে চলে যাই৷ আত্মহত্যার আগে-পরের নানা পরিস্থিতি ও আলামত বিবেচনা করে আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, আমার মেয়ে ব্লু হোয়েলের শিকার৷’
তরুণ-তরুণীরা কেন আকৃষ্ট হয়?
ব্লু হোয়েলে সাধারণত অবসাদগ্রস্ত তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গভীর রাতে বা একাকী দীর্ঘ সময় যারা ইন্টারনেটে সামাজিকমাধ্যম জগতে বিচরণ করে তারা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার যে আগ্রহ সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে ফেলে এর কিউরেটররা।
অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে সাহসের প্রমাণ দিতে বলা হয়। এজন্য তাদের ছোট ছোট কিছু সাহসী কাজ দিয়ে এগিয়ে নেয়া হয়। একবার এতে জড়িয়ে পড়লে আর সহসা বের হওয়ার সুযোগ থাকে না।
সহজ ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সাহস আছে কি না- এমন কথায় সাহস দেখাতে গিয়ে দিনকে দিন যুবক-যুবতীরা আকৃষ্ট হচ্ছে এই গেমে। তবে একবার এ খেলায় ঢুকে পড়লে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।
ব্লু হোয়েলে আসক্তদের চিনবেন কীভাবে?
যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনও আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।
এর থেকে বাঁচতে কী করা যায়?
এই মরণ ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন। সেগুলো হচ্ছে-
প্রথমতো আপনাকেই সচেতন হতে হবে। কেন আপনি অপরের নির্দেশনায় কাজ করবেন। আপনি যাকে কখনও দেখেননি, যার পরিচয় জানেন না, তার কথায় কেন চলবেন বা তার কথামতো কেন কাজ করবেন- সেটি নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।
এরকম কোনো লিংক সামনে এলে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে।
সমাজের তরুণ-তরুণীদের মাছে এই গেমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
সন্তান, ভাই-বোন বা নিকটজনকে মোবাইলে ও কম্পিউটারে অধিক সময়ে একাকী বসে থাকতে দেখলে সে কী করছে, তার খোঁজ-খবর নিতে হবে। সন্তানকে কখনও একাকী বেশি সময় থাকতে না দেয়া এবং এসব গেমের কুফল সম্পর্কে বলা।
সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মানসিকতা সৃষ্টি করা। যাতে তারা আত্মহত্যা করা বা নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা অনেক বড় পাপ- এটা বুঝতে পারে।
সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিনা- সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় তাকে সঙ্গ দেয়া।
কৌতূহলী মন নিয়ে এই গেমটি খেলার চেষ্টা না করা। কৌতূহল থেকে এটি নেশাতে পরিণত হয়। আর নেশাই হয়তো ডেকে আনতে পারে আপনার মৃত্যু।
কোন কোন দেশে আছে ব্লু হোয়েল?
এ পর্যন্ত ব্লু হোয়েল পৃথিবীর কোন কোন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, চিলি, চীন, ভারত, ইটালি, কেনিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, সৌদি আরব, সাইবেরিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও উরুগুয়ে ব্লু হোয়েল শনাক্ত হয়েছে। উৎস : যুগান্তর।