‘ওসি বুকে ওঠে, এসআই তাপস মাথা ধরে, এসআই সেলিম চোখ তোলে’
‘খুলনার গোয়ালখালী মোড় থেকে হঠাৎ পুলিশ আমাকে আটক করে। এরপর থানায় নিয়ে দুই দফা মারধর চালায়। আমার স্ত্রী ও মায়ের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় চিকিৎসার কথা বলে থানা থেকে বের করে নেয়। আবু নাসের হাসপাতাল পার হয়ে আমাকে বিশ্বরোডে যায় পুলিশ।’
‘সেখানে ব্রিজের আগে নির্জন স্থানে গাড়ি থেকে নামানোর পর পিঠের দিকে নিয়ে হাত বেঁধে ফেলা হয়। মুখের ভেতর গামছা ঢুকিয়ে দেয়। এরপর ওসি নাসিম খান বুকের ওপর উঠে বসে গলা চেপে ধরে। আমার মাথা শক্ত করে ধরে এসআই তাপস। এসআই সেলিম র্যাঞ্চ দিয়ে চোখ তুলে নেয়।’
হঠাৎ আটক হয়ে পুলিশের হাতে চোখ হারানো খুলনার শাহজালাল আজ রবিবার খুলনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই তার ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন।
ঘটনার তিন মাসের মাথায় খুলনা প্রেস ক্লাবে ডাকা এই সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল দাবি বলেন, ‘আমার পরিবার এখনও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। পুলিশ মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। কোনও রকম সাক্ষ্য না দিতে ভয় দেখাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনে যেন আসতে না পারি, সে জন্য পুলিশ বাধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা পেছনের দেয়াল টপকে অনেক কষ্টে এখানে এসেছি। সবসময় পুলিশের নজরদারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। বাসায়ও স্বস্তিতে থাকতে পারছি না।’
সংবাদ সম্মেলনে শাহজালালের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডভোকেট মিনা মিজানুর রহমান। এ সময় শাহজালাল, তার মা রেনু বেগম, বাবা মো. জাকির হোসেন, স্ত্রী রাহেলা বেগম, মানবাধিকারকর্মী মো. মোমিনুল ইসলাম ও শাহীন জামাল উপস্থিত ছিলেন। এসময় আরও উপস্থিত ছিল তার শিশুকন্যা আঁখি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শাহজালাল আরও বলেন, ‘পুলিশ বিভিন্নভাবে মামলা করার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। পুলিশ যদি ঘটনার দিনের থানার হাজতখানার সামনে সিসিটিভির রেকর্ড না মুছে ফেলে তাহলে ওই ভিডিও থেকেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া সম্ভব। ওই রাতে হাজতখানায় আটক থাকা অন্যরাও আমার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য দিতে পারবে। কিন্তু এখন পুলিশ নানাভাবে ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। একটি চোখের চিকিৎসা করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আবার তা নাকচ করেছে।’
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শাহজালালের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছিনতাই মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ১৬ অক্টোবর আদালতে ওই মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিনতাই মামলায় শাহজালাল জামিন পেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ কাউখালীর একটি মামলায় শাহজালালকে গ্রেফতার দেখায়। ওই মামলায়ও জামিন নিয়ে গত ৫ অক্টোবর শাহজালালকে খুলনা কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়।’
নাগরিক নেতা শাহিন জামাল বলেন, ‘শাহজালালের চোখ উৎপাটনের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকায় পরিবারটি চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এখন পুলিশের উচিত, আগে পরিবারটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু পুলিশ সে ধরনের কোনও দায়িত্ব পালন করছে না। যা উদ্বেগ ও হতাশাজনক।’
এদিকে টাকা না পেয়ে চোখ তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনার খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম খান বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়লে জনগণ তাকে মেরেছে। আমরা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। পুলিশ দশ মিনিট পরে গেলে হয়তো তার লাশ পাওয়া যেত।’
তিনি বলেন, ‘গোয়ালখালী বাসস্ট্যান্ডে সুমা আক্তার নামে এক নারী তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাচ্ছিলেন। রাস্তার সুমার ব্যাগ ছিনতাই করে নেওয়ার সময় শাহজালালকে ধরে মারধর করে জনগণ। আমরা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করি। পরবর্তীতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সুমা বাদী হয়ে দ্রুত বিচার আইনে ৩ ও ৪ ধারায় মামলা করেন।’
শাহজালালের বিরুদ্ধে খুলনার বিভিন্ন থানায় ছয় থেকে সাতটি মামলা রয়েছে বলেও দাবি করেন খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৮ জুলাই মো. শাহজালাল পিরোজপুরের কাউখালি উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের বাড়ি থেকে খুলনা মহানগরীর নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনির শ্বশুরবাড়িতে আসেন।
ওইদিন দিবাগত রাত ৮টায় শাহজালাল তার শিশুকন্যার দুধ কেনার জন্য বাসার পাশে গোয়ালখালী মোড় এলাকার দোকানে যান। ওই এলাকা দিয়ে রিকশায় করে যাওয়ার সময় সুমা আক্তার নামের একজন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। পুলিশ ওই এলাকা থেকে শাহজালালকে আটক করে খালিশপুর থানায় নেয়।
সূত্র: এমটিনিউজ