ম্যাডাম নেই তাই…
অনির্ধারিত সফরে টানা তিন মাস দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতারাও খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তার অনুপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে, থমকে আছে দল পুনর্গঠন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত। এমনটি মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
লন্ডনে অবস্থান নেয়া দলের চেয়ারপারসনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে মুখিয়ে নেতাকর্মীরা। আবার লন্ডন থেকে সুখবর নিয়ে আসতে না পারলে নেতাকর্মীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়বে, এ শঙ্কায়ও শঙ্কিত তারা। সর্বোপরি চিকিৎসা শেষে নেত্রী দ্রুত দেশে ফিরে ঝিমিয়ে থাকা দলের সাংগঠনিক কাজ আরও গতিশীল করার পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলের অবস্থান স্পষ্ট করবেন- এমন আশা নেতাকর্মীদের।
চোখ ও পায়ের চিকিৎসা করাতে গত ১৫ জুলাই লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘদিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা সেখানেই উদযাপন করেন তিনি। টানা তিন মাস লন্ডনে অবস্থানকালীন একটি শপিংমলে কেনাকাটা করতে দেখা গেলেও সেখানে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেননি খালেদা জিয়া।
দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বিশ্রামে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। যাতে দেশে ফেরার পর ফের লন্ডনে যেতে না হয়। তিনি শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন। সরকার গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে ভয় দেখালেও চেয়ারপারসন দেশে ফিরবেন।
দীর্ঘদিন লন্ডনে থেকে দলীয়প্রধান চিকিৎসার পাশাপাশি আর কী করছেন তা নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে। অনেকে বলছেন, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। লন্ডনে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবস্থান করছেন। দলটির ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি আগামী নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন ধরনের ছক তৈরি করছেন তারা। দেশে ফিরে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সেগুলো বাস্তবায়নে হাত দেবেন খালেদা জিয়া। এছাড়া দেশে ফেরার পর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে লন্ডনে যাওয়ার আগে নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান এবং সদস্য নবায়নের উদ্বোধন করে দুই মাসে এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহের টার্গেটের কথা বলেছিলেন খালেদা জিয়া। তবে তার অনুপস্থিতিতে এ কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেও টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের মতো আরও এক মাস সময় বাড়িয়েছেন।
খালেদা জিয়া দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, এমন যুক্তি দেখিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর বিএনপি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা থেকে বিরত রয়েছে। ফলে কমিটিতে পদপ্রত্যাশী নেতারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না পেয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পদপ্রত্যাশী নেতাদের মাঝেও।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাত সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রায় এক বছর পার হতে চললেও এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন সাবেক এই দুই ছাত্রনেতা। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশের বাইরে অবস্থান করায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তারা। খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করলে নিষ্ক্রিয় সংগঠনটি আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সাইফুল ইসলাম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয়তাবাদী যুবদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটি নয় মাস অতিক্রম করলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি নীরব ও টুকু। তারাও বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফিরলেই পরামর্শ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন।
এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। বর্তমান কমিটির মেয়াদ এক বছর পার হলেও এখনও তারা প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। নতুন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রত্যাশীদের মাঝেও হতাশা বিরাজ করছে। দল ঘোষিত কর্মসূচিতে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতি হতাশ করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে।
২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ৭৩৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিশালাকৃতির কমিটি করেও নানা জটিলতায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ছাত্রদল। তাই খালেদা জিয়া দেশে ফিরলে ছাত্রদলের কমিটির একটা সুরাহা হতে পারে বলে বিশ্বাস পদপ্রত্যাশীদের।
শক্তিশালী ইউনিট ঢাকা মহানগর বিএনপিকে উত্তর ও দক্ষিণ— এই দুই ভাগে ভাগ করে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার ৭০ সদস্যের কমিটি এবং উত্তরে এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসান উল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
আংশিক কমিটি গঠনের ছয় মাস পার হলেও কোনো ইউনিটে এখনও কমিটি গঠন করতে পারেননি মহানগরের নেতারা। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফিরলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতেও কমিটি ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি (সুপার ফাইভ) ঘোষণা করে বিএনপি। আংশিক কমিটির মেয়াদ দুই বছরে পা রাখলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে সংগঠনটির কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। ধারণা করা হচ্ছে, খালেদা জিয়া দেশে ফিরলেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে কাজ শুরু হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশের বাইরে অবস্থান করায় তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজও আটকে গেছে। খালেদা জিয়া দেশে ফিরলে ফের এটি শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মো. শাজাহান। তিনি জানান, কমিটি ঘোষণার আগে ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। তিনি তো চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। আমরা কয়েকটি কমিটি রেডি করে রেখেছি। তিনি দেশে ফিরলেই কমিটিগুলো ঘোষণা করব।
বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় শীর্ষ নেতারা সমন্বয় করছেন জানিয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। আধুনিক এ যুগে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সঙ্গে সেকেন্ডে সেকেন্ডে যোগাযোগ করা যায়। সাংগঠনিক কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সূত্র: জাগো নিউজ