176629

ব্লু হোয়েল : মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে যে অবাক করা তথ্য জানালেন সাদাফ

ডেথ গেমস ব্লু হোয়েলের ৫০তম ধাপের নির্দেশনা আত্মহত্যা। তবে এ গেমসের ১৩তম ধাপেই আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে রাজধানী মিরপুর কাজীপাড়ার কিশোর তৌফিকুল ইসলাম সাদাফ। মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে ২৭টি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে।

তবে সাদাফের মা বিষয়টি টের পেয়ে যাওয়ায় এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় ব্লু- হোয়েল আসক্ত এই কিশোর। সাদাফের মা ইতি ইসলাম জানান, মঙ্গলবার গভীর রাতে ব্লু-হোয়েল গেমে আসক্তি থেকে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় সাদাফ। গভীর রাতে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে দ্রুত নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।

সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। পরে গত বুধবার বিকাল ৫টার দিকে তার জ্ঞান ফেরে। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মেডিসিন থেকে মানসিক রোগ বিভাগে নেয়া হয়। শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি তার মানসিক চিকিৎসা চলছে। গতকাল দুপুরে ঢামেক হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে কথা হয় সাদাফ, তার বাবা তানজিলুল ইসলাম ও মা ইতি ইসলামের সঙ্গে।

সাদাফ বলে, আমি সবকিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। নতুন কিছু দেখলেই জানতে চাই। মাস দেড়েক আগে একদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের নামে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে আমার মোবাইলে। ভালো বেতনে অনলাইনে কাজের অফার। পরে দেখি তা স্পাম মেসেজ। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি তা ফেইক। সেখান থেকে ব্লু-হোয়েলের লিংকটা আমার মোবাইলে আসে। তা মোবাইলে লোড হয়। গেমটি খেলতে থাকি। এই গেমের মানসিক টেনশন নিতে না পেরে আমি একটি মোবাইল ভেঙে ফেলি।

সাদাফ জানান, আমি ব্লু-হোয়েল গেমসের অনেক ধাপ খেলেছি। কিউরেটরের কথামতো ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। পরে তা কিছুটা নেশায় পরিণত হয়। আমি জীবনমুখী ছিলাম। ধীরে ধীরে জীবন বিমুখ হতে থাকি। আলো ভালো লাগতো না। ঘর অন্ধকার করে রাখতাম। কিউরেটরের নির্দেশ মতো একে একে ভৌতিক মুভি দেখতে থাকি। ১৩টা ভৌতিক মুভি দেখেছি। গত কোরবানির ঈদের আগেই তারা হাত কাটতে বলে। ডান হাতে কাটাকুটি করি। তারপর বাম হাতে কলম দিয়ে একটি নীল তিমির ছবি আঁকি। পরে তা দেখে দেখে হাত কেটে আঁকার চেষ্টা করি। তেমন ভালো হয়নি। সে ছবি করে কিউরেটরকে পাঠাই।

এক ধাপে এসে তাদের নির্দেশনা মতো না চললে আমাকে নিখোঁজ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। তারা বলে যে, তাদের টাস্ক বা কাজ না করলে আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলবে। বাংলাদেশে তাদের টিম আছে। তারাই ওই কাজ করবে। আর এই গেম একবার ইনস্টল হলে আর ডিলিট করা যায় না। এক পর্যায়ে মনে হলো আর বেঁচে থেকে কী লাভ। তাই ত্রিশটা ঘুমের ওষুধ এক সঙ্গে খাই (তিনটা পড়ে গিয়েছিল, যা পরে তার মা কুড়িয়ে পান)।’

ছেলের ব্লু-হোয়েল গেমে ঢুকে পড়ার কথা জানতে পেরে ইতি ইসলামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেকে মৃত্যুর ফাঁদ থেকে ফেরানোর জন্য অনেক কিছুই করেন তিনি। ছোটেন মানসিক চিকিৎসকের কাছে। তার কথায় কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ইতি ইসলাম বলেন, আমার ছেলে খুব মেধাবী। আইটিতে যথেষ্ট পারদর্শী। এর আগে সে মনিপুরে স্টুডেন্টস কেয়ার স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে।

এ বছর নিজের ইচ্ছাতেই ভর্তি হয়েছে মিরপুর ১০-এর সরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সে পড়াশোনায় অমনোযোগী। খাবারে অনীহা। এর মধ্যে কোরবানির ঈদের আগে থেকে সে আর স্কুলে যেতে চাইছিল না। পর্দা দিয়ে ঘর অন্ধকার করে রাখতো। জানালা খোলা রাখতো। ঘরে ঢুকে আমরা আলো জ্বালালেও সে বের করে দিয়ে অন্ধকার করে ফেলতো।

বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলো বন্ধুদের কাছ থেকেও। দীর্ঘ সময় মোবাইল ও কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতো সে। একদিন দেখি সে সিগারেট খাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায়। এমনকি আমাদের সামনেও। নিজেই সে দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করছে। পরে দারোয়ান রতন বলে, কয়েকদিন সে রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে বের হয়ে ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করেছে। একদিন আমিও ভোর ৪টা ১৮ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে দেখি- সে তার কক্ষে নেই। খুঁজতে বের হই। তখন ছাদের দরজায় তালা ছিল।

নিচে নেমে দেখি সে দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি চুরি করে নিয়ে গেট খুলে ঘরের বাইরে চলে গেছে। তখন বাইরে বৃষ্টিতে ভিজছিল। কারণ জানতে চাইলে বলে, কিছু ভালো লাগে না, তাই। তখন আমি তাকে দু’টো থাপ্পড় দেই। তার বাবা বকে। এরপর গত কোরবানির আগে একদিন সে তার হাত ব্লেড দিয়ে কাটে। প্রথমে ডান হাত। আর বাম হাতে একটি তিমি মাছের ছবি আঁকে।

তা অনুসরণ করে ব্লেড দিয়ে বাম হাত কেটে নীল তিমির ছবি আঁকার চেষ্টা করে। সে ছবি নাকি সে ওই খেলার কিউরেটরকেও পাঠিয়েছে। একদিন তার ফুফি ডা. নুসরাত জাহান রিভা তার কাছে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, এটা কিছু না। একটা গেমের লোগো। আমি জিজ্ঞেস করলেও বলে- মা, এটা একটা গেমস। আর কিচ্ছু না। তখন সে বেশ ইংরেজি গানও শুনতো।

সাদাফের মা জানান, ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে আইটিতে দক্ষ আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে সব খুলে বলি। সেদিন বান্ধবী আমাকে কিছুই বলেনি। কয়েকদিন পরে বান্ধবী আমাকে ব্লু-হোয়েলের কথা বলে। সাদাফ নাকি এই গেমে আসক্ত- এমনটাও মন্তব্য করে। এ বিষয়ে কিছু ইংরেজি প্রতিবেদনও দেখায় সে।

আমার ছেলের আচরণ এই গেমের ৫০ ধাপের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তখন আমি আমার ছেলেকে ফোন করি। ব্লু-হোয়েল গেমের কথা বলতেই ছেলে সংযোগ কেটে দেয়। বাসায় ফিরে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি। তাতে নিশ্চিত হই, আমার ছেলে মরণ খেলা ব্লু-হোয়েলে মেতেছে।

ইতি ইসলাম জানান, এরপর ছেলের বাবাকে ফোন দিয়ে বলি- তোমার ছেলে মরণ খেলা ব্লু- হোয়েলে মেতেছে। যার শেষ ধাপ হলো- আত্মহত্যা। ছেলেকে বাঁচাও। গাজীপুরের এক পোশাক কারখানায় আইটি ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা তার পিতা তানজিল জবাব দেন, ব্লু-হোয়েল তো একটা বিদেশি গেম। সেটা বাংলাদেশে আসবে কীভাবে?

পরে আমরা ছেলেকে বুঝিয়ে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু ওই চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতে লেগে গেছে ১০ দিন। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ডাক্তার দেখাই। কিন্তু বার বার বলার পরও ওই চিকিৎসক ব্লু-হোয়েল গেমের কথা কানেই তোলেননি। পাঁচ মিনিটের ওই সাক্ষাতে চিকিৎসক ছেলেকে মানসিক রোগী উল্লেখ করে বেশকিছু মেডিকেল টেস্ট দেন। ৭ হাজার ২০০ টাকায় আমরা টেস্টগুলো করি।

ইতি ইসলাম বলেন, এরপর থেকেই মূলত আমি বন্ধুর মতো করে ছেলেকে সময় দিতে থাকি। তাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করি। বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘোরাতে নিয়ে যাই। ছেলে বললে আমি নিজে গান গেয়ে শোনাতাম। কিন্তু কিছুতেই তার মধ্যে আনন্দ দেখিনি। উল্টো সে বলতো, মা, তুমি যে আমাকে এত কিছু বোঝাও তার সবই আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। আমার কিছুই ভালো লাগে না। এ পৃথিবী আমার ভালো লাগে না। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তোমরা আমাকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। আমি গলায় ফাঁস নেব। এরপর আমি রাত জেগে ছেলেকে পাহারা দিতে শুরু করি।

ইতি ইসলাম আরো বলেন, অনেক সময় সাদাফ কথার ফাঁকে ব্লু-হোয়েলের কিছু কথা বলে ফেললেও পরে তা অস্বীকার করে। কথা গোপন করে। কথার ফাঁকে একদিন সে বলেছিল, যেদিন আমি ব্লু-হোয়েল ডাউনলোড করি, সেদিন বাবা আমার পাশে সোফায় বসে ভাত খাচ্ছিলো। কিছু বুঝতে পারেনি।

আত্মহত্যার চেষ্টার দিন মঙ্গলবার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইতি ইসলাম বলেন, আমি ডাক্তারের কাছে যাবো না। ডাক্তার আমার মনের সব কথা বের করে ফেলবে। আমার বাবা-মাকে কেউ হেনস্তা করলে আমার ভালো লাগবে না। আমি যেদিন গেমটা শেষ করবো- সেদিন আমার বাসায় পুলিশ আসবে। আমি সুইসাইড করবো। তোমরা আমাকে বাঁচাতে পারবে না।

সাদাফের চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ৭০১ নম্বর কক্ষে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে তার বাবা-মা’র প্রতি আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ইতি ইসলাম বলেন, জ্ঞান ফেরার পর ছেলে কেবল বলছে- সব দোষ তোমার। কেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছো। এখন তো ৩০টা খেয়েছি। এবার বাসায় গিয়ে দেখবে আমি কী করি। ৫০টা এক সঙ্গে খাবো।

সাদাফের পিতা তানজিল বলেন, সে যে ব্লু- হোয়েলে ঢুকে পড়েছিল তা আমরা পরে নিশ্চিত হই। আল্লাহর রহমতে এখন তাকে বাঁচানো গেল। ব্লু-হোয়েলের ফাঁদ থেকে যেন তাকে বের করে নিয়ে আসতে পারি সেজন্য মানসিক চিকিৎসা করা হচ্ছে।

জানা যায়, সাদাফ মনিপুর স্টুডেন্টস কেয়ার স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণির পিইসি পরীক্ষা দেয়ার আগেই গোঁ-ধরে। এনরয়েড মোবাইল ফোন কিনে না দিলে সে পরীক্ষা দেবে না। তখনই তাকে ৬ হাজার টাকায় একটি এনরয়েড ফোন কিনে দেয়া হয়। এরপর আবার গোঁ-ধরে জেএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগে। সেবারও তাকে আরো একটি এনরয়েড ফোন কিনে দেয়া হয়।

এর আগে সে দু’টি এনরয়েড ফোন ব্যবহার করেছে। তার কক্ষে রয়েছে কম্পিউটারও। সে প্রতিদিন একটা বড় সময় ধরে মোবাইল ও কম্পিউটারে গেমে ডুবে থাকতো। পড়াশোনা করতো কম। দু’একবার পড়লেই রপ্ত হয়ে যেতো পড়া। ওই দু’পরীক্ষায়ই সে এ প্লাস পেয়েছে। -এমজমিন

ad

পাঠকের মতামত