মিয়ানমার আর্মির বর্বরতায় বোবা হয়ে গেলেন যে মা
একটা গল্প বলি। শুরুটা এমন- ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। মা তখন রান্নাঘরে। ছোট ছেলেটা গরু আনতে পাশের পাহাড়ে যায়। এমনিতেই এলাকায় মিলিটারি অভিযানের নামে শুধু মানুষ মারা শুরু করছে। সেজন্য দিনভরও ভয়ে ভয়ে থাকে সবাই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে যমদূতগুলো যেন আশপাশে ঘুরতে থাকে। এ ভয় ও আতঙ্কে থাকা মায়ের কানে হঠাৎ একটা ধড়াস শব্দ বাজে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল।
রান্নাঘর থেকে বের হয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে গেলেন। পাহাড়ের কোলে বেঁধে রাখা গরুগুলো দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল, উপুড় হয়ে কেউ একজন শুয়ে আছে। গায়ের পোশাকটা চোখে পড়তেই বুকের ভেতর খুব জোরে একটা মোচর দিল।
কাছে যেতেই চিৎকারে করে গলা ফাটিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। এ যে তারই আচলভক্ত ছেলেটা। নিথর পাহাড়ের কোলে পড়ে আছে। গুলি করে মেরে দিয়েছে মিলিটারি।
গুলিবিদ্ধ ছেলেকে উপুড় থেকে সোজা করে কোলে তুলতে চাইলেন। ঠিক ওই মুহূর্তে চোখ গেল বাড়ির দরজার দিকে। কয়েকজন মিলিটারি সদস্য তাদের বাড়ির দিকে ঢুকছে। মা বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। আশপাশেও কাউকে দেখছেন না।
ছেলের দেহটাকে সেখানে রেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটে এলেন। ততক্ষণে দুই মেয়েকে ঘরের ভেতর আটকে দিল মিলিটারি। কয়েকজন ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। চারজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই দুজন মিলিটারি মাকে ধরে ফেলল। ঘরের পাশের একটা গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে তাকে বাঁধল। তার চিৎকার-চেচামেচি মিলিটারির হৃদয় গলায় না, বরং আরও পাশবিক করে তোলে। মায়ের গায়েও হাত দেয়। ওদিকে ঘরের ভেতর থেকে দুই মেয়ের গগণবিদারী চিৎকার ছুটে আসে, এদিকে মায়ের। মিলিটারি মাকে গুলি করে। পায়ে গুলি লাগে, মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
কিছুক্ষণ পর বিকট একটা শব্দে ফের জ্ঞান ফেরে মায়ের। চারদিক তখন নিস্তব্ধ। ঘরের ভেতর থেকেও কোনো শব্দ আসছে না। চার মিয়ানমার সৈন্য ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সৈন্যের পোশাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জানোয়ারগুলো হাসছে। হাসি শেষ হতেই দুই জানোয়ার ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধাউ ধাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে ছেয়ে যায় চারদিক। কিছুই দেখা যায় না।
গুলিতে মা মরে গেছেন ভেবে তাকে ওই অবস্থায় রেখে মিলিটারিরা চলে যায়। ঘরে ধর্ষিত মেয়েদের জ্বলতে দেখে মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ফের জ্ঞান হারান।
চলচ্চিত্রের গল্পগুলোও এতো বর্বর না হলেও মিয়ানমারের মংডু নাছাইদং এলাকার বাসিন্দা জায়েদা বেগমের জীবনের বাস্তব করুণ গল্প এটি। এই বর্বরতা তাকে বোবা করে দিয়েছে। তিন সন্তান হারানোর শোকে স্তম্ভিত ও গুলিবিদ্ধ জায়েদা সম্প্রতি ছোট ভাইয়ের কাঁধে ভর করে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
দূর থেকে দেখে মনে হয়, কোনো মৃত মানুষকে কাঁদে করে কেউ একজন নিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই প্রতিবেদক এগিয়ে যান। টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপে নদীর এপাড়ে এসে বোনকে কাঁধ থেকে নামান ভাই।
হতভম্ব জায়েদার গুলিবিদ্ধ পায়ের রক্ত শুকিয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন জায়েদা। পরনের ছেঁড়া কাপড় থেকে মনে হচ্ছে মহাপ্রলয় থেকে বেঁচে ফিরেছেন তারা।
জায়েদার কাছে বারবার অনেক প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর মেলেনি। এ সময় সঙ্গে থাকা ছোট ভাই ইউসুফ আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বোন কোনো কথা বলতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কথা বলে না। বোবা হয়ে গেছেন।
কীভাবে এমন হলো জানতে চাইলে ছোট ভাই ইউসুফ আলী বলেন, সন্ধ্যার আগে জায়েদার বাড়িতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আসে। পাহাড়ের কোলে ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলে। জায়েদাকে বেঁধে রেখে চোখের সামনে তার দুই মেয়েকে ধর্ষণ করে। পরে তাদেরও গুলি করে মেরে ফেলে। এর আগের দিন জায়েদার স্বামী তমিজ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
ইউসুফ আরও বলেন, সেনারা চলে গেলে আমি বোনের বাড়ি ছুটে যাই। তখন বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বোনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা অবস্থায় ফেলে যায়। তখন ওর কোনো হুশ ছিল না। পরে আমি গিয়ে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে কাঁধে করে পাহাড়ের দিকে নিয়ে আসি। ওখানে এনে গাছের লতাপাতা দিয়ে তার পায়ের রক্ত বন্ধ করি।
ইউসুফ আলী জানান, অনেক চেষ্টার পর বোনের জ্ঞান ফেরে। তখন থেকেই কাঁদছে। কিন্তু কোনো কথা বলছে না। নদী থেকে পানি নিয়ে শরীর মুছে দিলাম। মাথায় পানি দিলাম। পানি খাওয়ালাম। কথার বলানোর জন্য চেষ্টা করলাম। কিন্তু কথা বলছে না।
পরে ওই অবস্থায় বোনকে কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিই। সারারাত হেঁটেছি। সকালে নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে আসি। সেখান থেকে নাফ নদী পার হয়ে ট্রলারযোগে বাংলাদেশে রওয়ানা দিই। একরাত একদিন পর বাংলাদেশের সীমান্তে আসি।
ইউসুফ অালীর পরিবারের কথা জানতে চাইতেই আবারও কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, আমার বাড়ি বোনের বাড়ির পাশেই। আমরা একই গ্রামের বাস করতাম। এর আগের দিন মগ ও সেনারা আমাদের বাড়িতে আসে। দুই সন্তানকে নির্যাতন করে জবাই করে মেরে ফেলে। বউকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। তিনজনের রক্তাক্ত মরদেহ লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে চলে যায় মগ ও সেনারা। আমি বাড়িতে ফিরে দেখি, আগুন জ্বলছে। এক সন্তান আগুনে পুড়ে যায়। আরেক সন্তান এবং বউয়ের লাশ নিয়ে পাহাড়ের দিকে আসতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চোখে পড়ে যাই। পরে সেখানে লাশ রেখে পাহাড়ের দিকে আমি পালিয়ে যাই। পরে এসে দেখি ওখানে লাশ নেই। ওই রাতে পাহাড়েই ছিলাম।
পরের দিন বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হই। দুইদিন পর আজ বাংলাদেশে এলাম। গত চারদিন ধরে আমি কিছুই খাইনি। আমি জানি না কেন আমার বোন কথা বলছে না। দুই মেয়েকে নির্যাতনের দৃশ্য হয়তো বোনকে বোবা করে দিয়েছে। গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে ছেলে সন্তানকে। এর চেয়ে বড় নির্মমতা আর কী হতে পারে।
এমন ঘটনা একটি নয়, এটি এখন রাখাইন রাজ্যের নিত্যদিনের ঘটনা। এমন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, পালিয়ে আসা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই–বলেন ইউসুফ আলী।
মিয়ানমারের মংডু বলিবাজার এলাকার আরেক বাসিন্দা আছিয়া খাতুন। ছেঁড়া শাড়ি পরা শাশুড়ি মরিয়ম বেগমকে নিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পার হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেন। কথা হয় আছিয়ার সঙ্গে।
ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে আছিয়া বলেন, চোখ বেঁধে স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। তিন সন্তানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় সেনারা। দুই শিশু আর শাশুড়িকে নিয়ে পালাতে থাকি। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বনে-জঙ্গলে পালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট হয়েছে। কোলের দুধের শিশুটি সারারাত কেঁদেছে। কয়েকবার শিশুটির মুখ চেপে ধরেছি। কারণ কান্নার শব্দ সেনাদের কানে গেলে হয়তো আমরা ধরা পড়ে যাব।
দৌড়াতে দৌড়াতে সীমান্তের দিকে যাই। বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু নাফ নদীর সীমান্তে আসার আগে পেছনে ফিরে দেখি আমার ছোট ছেলেটি নেই। কেউ ধরে নিয়ে গেছে নাকি পাহাড়ের গর্তে পড়ে গেছি জানি না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি।
এদিকে, কোলের শিশুটির কান্না থেমে গেছে। ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছে। এই সুযোগে বাংলাদেশের সীমান্তে চলে যাই। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর দেখি, কোলে শিশুটির মুখ দিয়ে দুধ বের হয়। মুখ মুছে আবার দৌড়াতে থাকি।
নাফ নদীর সীমান্তে এসে ট্রলারে উঠব। বৃদ্ধ শাশুড়ি অনেকটা অসুস্থ হয়ে গেছেন। কোলে শিশুটি চুপ। তবুও ট্রলারে উঠি। ট্রলারে উঠার পর শিশুটিকে জাগাতে চাইলাম। কিন্তু সে আর জাগে না। অনেক চেষ্টা করলাম। কোনো কাজ হলো না। কেউ একজন বলল, শিশুটি মরে গেছে। আমি তখনও জানি না আমার দুধের শিশুটিও চিরতরে চুপ হয়ে গেছে। শেষের মধ্যেও সব শেষ। শেষসন্তানটিও মরে গেছে।
আছিয়ার মতো স্বামীহারা, সন্তানহারা, সম্ভ্রমহারা, ঘরহারা, শেকড়হারা, মাতৃভূমিহারা লাখ লাখ রোহিঙ্গা আজ পাগলের মতো ছুটছে প্রাণ বাঁচাতে। এরা জানে না, কী তাদের অপরাধ। মিয়ানমারের সরকারপ্রধান অং সান সু চি জানেন কি?