একটি তক্ষক’পেলেই মূল্য হাজার কোটি টাকা!
প্রাণিটির নাম ‘তক্ষক’। দেখতে গুই সাপের বাচ্চার মতো। গায়ে লাল সিঁদুরের ও সাদা ফোঁটার মতো রয়েছে। আকারে ছোট। তবে ছোট হলেও অনেক বয়সী। চড়ামূল্যে বিক্রি হয় এই প্রাণিটি। তাই অনেকেই এটির সন্ধানে ঘুরে ঘুরে নিঃস্ব হতে বসেছেন। তবু তারা হতাশ নন, খুঁজেই চলছেন।
যেখানে সন্ধান পাচ্ছেন, সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন। তাদের মতে, এই প্রাণির দুই ধরনের পা রয়েছে। কোনটার ‘মুরগী পা’ আর কোনটার ‘হাঁস পা’। ‘হাঁস পা’গুলোর দাম খুব বেশি। সর্বনিম্ন সাড়ে ৯ ইঞ্চি লম্বা ও ৫২ গ্রাম ওজনের ‘হাঁস পা’ চলে। এর কম ওজন বা লম্বায় সাড়ে ৯ ইঞ্চির ছোট হলে চলবে না।
ইঞ্চির মাপ ধরা হয় চোখ থেকে লেজের শেষ পর্যন্ত। ‘মুরগি পা’গুলো ২৫৫ গ্রাম ওজন ও সাড়ে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। এ ছাড়া একটা আছে ‘বার্মিজ’। ‘বার্মিজটা’র ওজন সাড়ে তিনশ গ্রামের নিচে হলে বিক্রির অনুপযুক্ত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এটি সরিসৃপ জাতীয় প্রাণি। এরা নিশাচর। গাছের গর্তে বাস করে। বিভিন্ন পোকামাকড়, পাখির ডিম খেয়ে এরা বেঁচে থাকে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ায় অনেকেই পোষা প্রাণির মতো তক্ষক লালন করে বলে শোনা যায়’। তারা মনে করেন, এই প্রাণি বাড়িতে থাকলে তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। নিঃসন্তানদের সন্তানাদি হয়।
তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত কিছু কিছু দ্বীপাঞ্চলে এই প্রাণি রয়েছে। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, তক্ষকের বিষয়টি আমরা এখনো পরিষ্কার হতে পারিনি। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জানা গেছে, পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে এই প্রাণি চড়ামূল্যে বিক্রি হয়। তক্ষকের ওষুধি গুণ রয়েছে বলে শোনা যায়।
কোনো কোনো দেশে এ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে থাকতে পারে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রাণি বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-দাম হয় দুইভাবে। একটা থোক। আরেকটা স্ক্যান করে প্রাণির শরীরে থাকা ‘দানা’ হিসেব করে।
তবে বেশির ভাগ বিক্রেতা স্ক্যানের বিপক্ষে। তারা থোক দরদাম করেন। তক্ষক দিয়ে কী করা হয়- জানতে চাইলে কেউ বলেন, প্রাণীটা পুরো গলিয়ে ক্যান্সারসহ দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এই প্রাণী কাউকে কামড় দেওয়ার পর তার ঘাঁ শুকিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির শরীরে কোনো ধরনের রোগ-জীবাণু থাকবে না।
আবার কেউ কেউ বলেন, এটার শরীরে থাকা দানা এক করে ড্রোন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।
এই প্রাণির সন্ধানে ঘোরা মানুষদের সঙ্গে আরেক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করছেন। ঢাকা থেকে গিয়ে প্রতারণার শিকারও হন তারা। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার আব্বাস নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি অধিক লাভবান হওয়ার জন্য এর পিছনে অনেক টাকা খরচ করেছেন।
পিরোজপুরের নাজিরপুরে একটা কিনতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা ধরা খেয়েছেন। তারা যেটা দেখিয়েছিল বাক্সে দেওয়ার সময় আরেকটা দিয়ে দেয়। বাসায় এসে দেখেন যেটা দিয়েছে তা অনেক ছোট।
তিনি জানান, তার দুটি গাড়ি ছিল। এর পিছনে ঘুরে গাড়ি দুটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। একই এলাকার ইলিয়াচ জানান, তিনি চট্টগ্রাম থেকে চারটি তক্ষক ধরে এনেছিলেন। বিক্রির জন্য তার এক পরিচিত লোকের কাছে দিয়েছিলেন। সে তাকে মাত্র ৬০ হাজার টাকা দেয়।
এর দাম অনেক শুনে তিনি পরে আবার রাঙ্গামাটি যান এই প্রাণীর সন্ধানে। সেখানে যাওয়ার পর ওখানকার সিন্ডিকেটের লোকজন তাকে ধরে মারধর করে। তার টাকা পয়সা মোবাইল সব কিছু রেখে দেয়। বেঁচে ফিরতে পেরেছেন তাই আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।
‘হাঁস পা’য়ের দাম বেশি শুনে কেউ কেউ আবার সার্জারি করে ‘হাঁস পা’ লাগিয়ে নেয়। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার জিহির নামের এক ব্যক্তি সার্জারিতে পারদর্শী। তিনি বাদুরের ডানা দিয়ে সার্জারি করেন। তাই প্রতারণার জন্য অনেকে তার ধরনা দেন। তবে বায়ারের ক্যামিস্টরাও সতর্ক।
তারা এটা ধরে ফেলতে পারেন। সারা দেশেই এখন এই প্রাণীটি বেচাকেনার সিন্ডিকেট আছে। ঢাকা থেকে যারা কিনতে চান, তারা প্রথমে জেলা শহরের সিন্ডিকেটের কাছে প্রাণীর ছবি চান।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের টিবোটে ২২ ইঞ্চি লম্বা এই তক্ষকের সন্ধান পাওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়।
তিনি জানান, ওখানকার চা বাগান থেকে চা-শ্রমিকরা প্রাণীটা ধরেছে। আমরা দুইদিন গিয়ে হোটেলে অবস্থান করি। তারা আমাদের প্রতি বিশ্বাস আনতে না পারায় প্রাণীটা আর দেখায় নি। তবে আমরা যাওয়ার আগে তারা ভিডিও পাঠিয়েছিল।