’এক শাহজাদা মুস্তাফার জন্য লাখো হৃদয়ে কান্না’
অটোমান সাম্রাজ্যের সোনালী যুগ নিয়ে তৈরি সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমানের’ আরেকটি বিয়োগাত্মক পর্বের সমাপ্তি ঘটলো। ফাঁসি কার্যকর করা হলো সুলতান সুলেমানের সবচেয়ে যোগ্য উত্তরসুরী বড় ছেলে শাহজাদা মুস্তাফার। আর তার এ পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না সৈনিক শিবির থেকে সাধারণ জনগণও। এমনকি তার সৎ ভাই শাহজাদা জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে শাহজাদা মুস্তাফা কতটা মানুষের হৃদয় জয় করে নিতে পেরেছিলেন।
‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শাহজাদা মুস্তাফা। সুলতান সুলেমানের নির্দেশে, তারই সামনেই প্রাণ কেড়ে নেয়া হলো শাহজাদা মুস্তাফার। মুস্তাফাকে হত্যার পর সৈন্যশিবিরে ব্যাপক ক্ষোভ ও কান্নার অভিব্যক্তি দেখা যায়। তার সৎ ভাই শাহজাদা জাহাঙ্গীরকেও ব্যাপক কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। হতাশ হয়েছেন তার লাখো অনুসারি, যারা তাকে সাম্রাজ্যের পরবর্তী সুলতান হিসেবে চেয়েছিলেন।
সুলতান সুলেমানের বাল্যবন্ধু ও প্রধান উজির ‘ইব্রাহীম পাশা’র পর এই চরিত্রটির ব্যাপারে দর্শকের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। এবার ‘শাহজাদা মুস্তাফা’ চরিত্রের নির্মম পরিণতি দেখলো। সেই সাথে দেখলো অন্দরমহলের ষড়যন্ত্রের জালে কীভাবে আটকা পড়ে গেলেন সুলতান সুলেমান। গল্প অনুসারে বলতে হয়, তিনি তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় ভুলটুকু করে বসলেন।
‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজটি নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে দীপ্ত টিভিতে। ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজে ‘শাহজাদা মুস্তাফা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুর্কি মডেল, চিত্রনায়ক ও প্রযোজক মেহমেত গুনসুর। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ১৯৯৭ সালে। ছবির নাম ‘হাম্মাম’। এরপর এ পর্যন্ত তিনি ১৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
চলচ্চিত্রের আগে ১৯৮৯ সালে মেহমেত যুক্ত হন টেলিভিশনের কাজের সঙ্গে। ছোট পর্দার অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য সিরিজে কাজ করেছেন তিনি।
প্রায় সাত শ বছর ধরে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এই সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপোড়েনে অটোমান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা ও দাসপ্রথার অন্তরালে কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজ। এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সুলতানকে প্রেমের জালে আবদ্ধ করে এক সাধারণ দাসীর সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার কাহিনি।
সুলতান সুলেমান : সিনেমায় ও ইতিহাসে
মাসুদ মজুমদার
ইতিহাসের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিবিড় এবং সহজাত। ইতিহাস শুনতে, বলতে এবং স্মৃতি তর্পণ করতে মানুষ আনন্দ পায়। ইতিহাস নিয়ে যারা ভাবেন, খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে ইতিহাস-অন্বেষা এক ধরনের নেশা। ইতিহাসের প্রতি আগ্রহের কারণেই ভগবান এস গিদওয়ানির ‘সোর্ড অব টিপু সুলতান’ এখনো উপমহাদেশের সব ধর্মের মানুষকে নাড়া দেয়। নির্মাণশৈলীর কারণে ইতিহাসের প্রকৃত মহিশুরের হায়দার আলীর পুত্র টিপু সুলতান আর সোর্ড অব টিপু সুলতানের মধ্যে কিছু ফারাক সহজেই বোধগম্য।
তবে গিদওয়ানি ইতিহাস বিকৃতির দায় নিতে চাননি। তাই শিল্পসৌন্দর্য ইতিহাসের সত্যকে আড়ালে নিয়ে যায়নি। বাংলাদেশের মানুষ পলাশী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে ইতিহাস পড়ে জানেনি। খান আতার কালজয়ী সিনেমা দেখে চিনেছে ও জেনেছে। খান আতা ইতিহাসকে আশ্রয় করে শিল্পের আবেগকে সুনিপুণ হাতে কাজে লাগিয়েছেন। ইতিহাস সত্যের সাথে শিল্পের সৌন্দর্য একাকার করে নতুন এক সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই কল্পনা-আশ্রয়ী থ্রিলার আর ইতিহাসের চরিত্র আলাদা হতেই পারে।
দস্যু বাহরাম, বনহুর প্রমুখ লেখক-কল্পনার বহিঃপ্রকাশ, রবিনহুড সার্বিক অর্থে তা নয়। ইতিহাস-সত্যের কাছাকাছি থাকার গরজে এই পার্থক্যটুকু মাথায় রাখা জরুরি। ইতিহাস-আশ্রয়ী নাটক সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণও ইতিহাস প্রীতি।
বলিউড, টালিউড, হলিউড ও লাহোরকেন্দ্রিক স্টুডিওগুলো থেকে প্রচুর ইতিহাস-আশ্রয়ী, ইতিহাস দ্বারা অনুপ্রাণিত কিংবা ইতিহাসকেন্দ্রিক নাটক-সিনেমা ও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা হয়েছে।
যেমন ‘আউর তলোয়ার টুট গেই’, ‘আখেরি চাটান’, ‘ছিনলে আজাদি’। বলা চলে ইতিহাসভিত্তিক সিনেমাগুলো দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের সহজাত মোহ অথবা পেছনে তাকাবার দায়বদ্ধতার এটাও একটা নজির। ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা মহানায়কদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণের প্রচুর কাজ হয়েছে। ধর্মীয় নেতা, বিদ্রোহী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও ব্যতিক্রমী চরিত্রের প্রভাবক মানুষগুলোও এ তালিকা থেকে বাদ পড়েননি।
আমাদের দেশে ফকির মজনু শাহ, শহীদ তিতুমীর একমাত্র উপমা নয়, গান্ধী থেকে ম্যান্ডেলা, আদম-ইভ থেকে মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র কিংবা ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে। দি মেসেজ ও মেসেঞ্জার ছাড়াও রয়েছে অনেক দৃষ্টান্ত।
এরই ধারাবাহিকতায় অটোমান বা ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম দিকপাল মহান সুলতান সুলেমানকে নিয়েও কাজ হয়েছে। আরবের স্বাধীনতাকামী নেতা ওমর মোখতার নিয়ে যে সিনেমা তৈরি হয়েছে, তা স্বাধীনতাকামী যেকোনো মানুষকে আলোড়িত করে। তবে সিনেমা তৈরির সময় রচনাকারী, প্রযোজক, পরিচালক ভুলে যান না এর মধ্যে বিনোদন এবং কাহিনী কাব্যের রসদ না দিলে দর্শক টানবে না।
মেরাল ওকেয় রচিত সুলতান সুলেমান নির্মাণের সময় ইয়ামুর তাইলানরা সেই বাস্তবতাটি ভুলে যাননি। বিনোদন উপস্থাপন করতে গিয়ে শাসক সুলতান সুলেমানকে কিছুটা আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হেরেমের কূটকচাল, দাস-দাসীদের দৈনন্দিন জীবনাচার এবং সুলতানাদের স্নায়ুযুদ্ধ বিনোদন জোগান দেয়ার স্বার্থে প্রাধান্য পেয়ে গেছে।
হেরেমের ড্রেস কোড খোলামেলাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সিরিজজুড়ে অন্দরমহলের প্রাধান্যের কারণে একজন সুশাসক, তুখোড় কূটনীতিক ও বিচক্ষণ সুলতানের পরিচিতি তুলনামূলক কম গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। সিরিজগুলো ‘আকর্ষণীয়’ ও আদিরসাত্মক করার জন্য যত গোঁজামিলই দেয়া হোক, কোনো জননন্দিত সুশাসক রমণীকাতর কামিনীবল্লভ হন না। এ ব্যাপারে সুলতান সুলেমানও ইতিহাসের কাছে অভিযুক্ত নন।
ইতিহাসের পাঠক এবং ইতিহাস-অনুপ্রাণিত দর্শক ভুলে যেতে পারেন না, বিনোদনের রসদ জননন্দিত কোনো শাসকের বৈশিষ্ট্য নয়। ইতিহাসের অংশও নয়। তবে সামগ্রিক জীবনের অংশ।
সম্প্রতি সুলতান সুলেমানের ওপর নির্মিত আলোচিত-সমালোচিত কাহিনী নাটকটি একটি বেসরকারি চ্যানেল দেখাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত সিরিজ প্রদর্শিতও হয়ে গেছে।
এই প্রজন্মের কাছে ইতিহাসখ্যাত সুলতান সুলাইমান বা সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে নির্মাণশৈলী ও বিনোদনের রসদ দিয়ে হেরেমের কাহিনীগুলো যেভাবে রগরগে করে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে এ যুগে ‘দর্শকপ্রিয়তা’ পাওয়ারই কথা। নতুন চ্যানেলটি সুলতান সুলেমান দেখিয়েই কিছু পরিচিতি পেয়েছে।
বাস্তবে বা ইতিহাসের সুলেমান-১ হেরেমের নায়ক নন। ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়ক। প্রথম সুলেমান অটোমান বা তুর্কি খলিফাদের মধ্যে সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি একটানা ৪৬ বছর (১৫২০-১৫৬৬) সাম্রাজ্য শাসন করেছেন।
তিনি সময় মেপে পথ চলেননি, সময় যেন তাকে অনুসরণ করেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসবেত্তারা তাকে ‘গ্রেট’ এবং ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মিলিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের তখনকার বিস্তৃতি ছিল তিন মহাদেশের বিরাট অংশজুড়ে।
সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সন্তানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড।
মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইস্তাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন। পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান।
নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন। তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুলতান সেলিম-১ ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে জিতে ১৫১২ সালে ক্ষমতায় বসেন। তখন পিতার ইচ্ছানুযায়ী সুলেমান ইস্তাম্বুলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং তার বাবার পক্ষ থেকে চাচাদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
তখনো শাহজাদা সুলেমান সরুহান প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পিতা সুলতান সেলিম-১ মারা গেলে সুলেমান ১৫২০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সর্বসম্মতভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা বা সুলতান মনোনীত হন।
সুলেমানের খলিফা বা সুলতান হওয়ার বিষয়টি কিংবদন্তি হয়ে আছে। তার নামের প্রস্তাব আসে সাধারণ মানুষ, অমাত্য এবং সব ‘পাশা’র কাছ থেকে। সে সময় একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি- যিনি তার নামে প্রস্তাব আসার পর দ্বিমত পোষণ করেছেন। পৃথিবীর কম শাসকই এতটা বিতর্কহীন ও সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হতে পেরেছেন।
সবাই জানত, সুলেমান একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও ধার্মিক মানুষ। তিনি কখনো তার কমান্ড নষ্ট হতে দিতেন না। সুলতান সুলেমান তার জনগণের কাছ থেকে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য পাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিলেন।
সুলতান এতটাই ধীমান ছিলেন, তার প্রতিটি বক্তব্য হতো শিক্ষণীয় ও নির্দেশনামূলক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবতেন; শৈথিল্য মানতেন না। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্রান্তিকালে কখনো ধৈর্য হারাতেন না। ১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে সুলতান সুলেমান অভিযানে থাকা অবস্থায় হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে নিজ তাঁবুতে ইন্তেকাল করেন। তার এই মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক এবং বার্ধক্যজনিত। তাকে দাফন করা হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুলে।
তার সমাধিস্থলেই বিখ্যাত সুলেমানি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্য প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ যারা পড়ে থাকবেন, তারা তুরস্ক ও ইস্তাম্বুল সম্পর্কে ধারণা পাবেন। হালে প্রচার করা হচ্ছে, একটি লোককাহিনী।
কথিত আছে, সুলতান সুলেমানের মূল কবর তুরস্কে হলেও তার হৃৎপিণ্ডটি হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরের আঙ্গুর কুঞ্জে কবর দেয়া হয়েছিল। এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত মত নয়। তার পরও সুলেমানের ‘হৃদয়ের খোঁজে’ বহুজাতিক বিশেষজ্ঞ দল এখনো সক্রিয় রয়েছে।
ইতিহাসে সুলেমান আইনপ্রণেতা বা ‘কানুনি’ হিসেবে বিশেষভাবে ছিলেন পরিচিত। সুলেমানের আইন গবেষণার ফসল তিন শ’ বছর ধরে কার্যকর ছিল। ইউরোপও এর মাধ্যমে লাভবান হয়েছে। তিনি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সৎ এবং সাহসী শাসক।
সেটা ছিল সাম্রাজ্যের সোনালি যুগ, তখন সৌভাগ্যের সূর্য ছিল মধ্যগগনে। কখনো তার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও প্রজা নিপীড়নের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। একবার মিসর থেকে অতিরিক্ত খাজনা জমা হওয়ার পর তিনি তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অনুসন্ধান করে বের করলেন- প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের কারণেই অর্থভাণ্ডারে করের আয় বেড়েছে এবং মিসরের সেই গভর্নর নিপীড়ক ছিলেন।
সুলতান দ্রুত সেই গভর্নর পরিবর্তন করেছিলেন। ইসলাম নিয়ে সুলতান সুলেমানের কবিতা বিশ্বের উৎকৃষ্ট কবিতাগুলোর কাতারে স্থান পেয়েছে। সুলেমান তার পরামর্শকদের মধ্যে শিল্পী, চিন্তাবিদ, ধর্মবেত্তা ও দার্শনিকদের বেশি ঠাঁই দিয়েছিলেন এবং তাদের কদর করতেন। এ কারণে ইউরোপের তুলনায় তার বিচারব্যবস্থা, আদালত ও শাসনব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি উন্নত, নিরপেক্ষ, মানবিক, ন্যায়ানুগ এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ওই সময়কার ইউরোপীয় রাজনীতি-অর্থনীতি সুলতানের নখদর্পণে ছিল।
মার্টিন লুথার, প্রটেস্টান্ট ধর্ম ও ভ্যাটিকানের ব্যাপারে তার গভীর উৎসাহ ছিল। তাদের সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানও তার ছিল। সুলতান মিথ্যা বলা পছন্দ করতেন না। কর্তব্যে অবহেলা মেনে নিতেন না, বাহুল্য কথা বর্জন করতেন, হালাল হারাম মেনে চলতেন। তার নির্দেশনা ও বক্তব্য হতো নীতিবাক্যের মতো। সহজেই শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে সুলতান এতটাই আমানতদার ছিলেন যে, তার ওপর নির্ভরতায় কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ম্লান হতো না। অপরাধী কোনোভাবেই পেত না প্রশ্রয়।
দেখতে সুলেমান ছিলেন সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, ফর্সা এবং গাঢ় বাদামি ছিল তার চোখ, নাক ছিল খাড়া ও সরু। চোখের ভ্রু ছিল জোড়া লাগানো। দীর্ঘ ছিল তার গোঁফ, দাড়ি ছিল সুন্দর, ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর ও অসাধারণ। তার কণ্ঠস্বর ছিল স্পষ্ট ও ভরাট। তাকে দেখলেই মনে হতো আত্মবিশ্বাসী, বীর, দৃঢ়চেতা ও শক্তিধর। সৌভাগ্য ও অনুকূল পরিবেশ যেন সব সময় তার চার পাশে ঘিরে থাকত।
মাহিজিবরান, খুররম, গুলফাম ও ফুলেন ছিলেন তার স্ত্রী চতুষ্টয়। সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোস্তাফা- এই আট পুত্রসন্তানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমান ও রেজায়ি।
তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়।
বাংলাদেশে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে, এটি সম্ভবত ইংরেজি থেকে ডাবিং করা। তবে বাংলা ডাবিং মন্দ নয়, ডাবিংবিচ্যুতিও কম। শব্দচয়নে সতর্কতা লক্ষণীয়- যা ডাবিংয়ের প্রাণ। সন্দেহ নেই, সুলতান সুলেমান একটি প্রাণবন্ত সিরিজ।
ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দায়বোধের জায়গা থেকে একটা কথা বলে রাখার গরজ বোধ করছি, এ সিনেমায় সুলেমান হেরেম ও সাম্রাজ্যের নায়ক। ইতিহাসের সুলেমান আরো বেশি বর্ণাঢ্য, সুশাসক, বিজয়ী ও মহানায়ক।
১৯২১ সাল পর্যন্ত অটোমান বা তুর্কি খেলাফত ব্যবস্থা টিকে ছিল। আমরা তুর্কি খেলাফতকে নিজেদের ভেবেছি। তার অংশ হওয়াকে গৌরবের বিষয় জেনেছি। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
কামাল আতাতুর্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্তির ঘোষণা দিলে উপমহাদেশজুড়ে খেলাফত পুনরুদ্ধার আন্দোলন শুরু হয়। সেটাই ইংরেজবিরোধী আজাদি আন্দোলনের মাত্রা পায়। গান্ধীজীও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়েছেন। পুরো ইউরোপ সুলতান সুলেমানকে সমীহ করে চলত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শ্রদ্ধাভরে তার আনুগত্য করাকে দায়িত্ব ভেবেছেন।
সেই দিনগুলোতে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা ধর্মীয় নেতা এবং উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন। আমাদের ইংরেজ শাসনবিরোধী আজাদি আন্দোলনের শুরুর দিকে শায়খুল হিন্দসহ সবাই তুর্কি খলিফাদের সাহায্য নিয়েছেন। রুটি ও রেশমি রুমাল আন্দোলনে তুর্কি পাশা ও খলিফাদের সমর্থন ইতিহাসস্বীকৃত বিষয়।
বিশ্বাস ও নাড়ির টান সুলেমানকে আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়। সেটি বিনোদনের সুড়সুড়ি এবং বাঁধহীন ব্যত্যয় বিচ্যুতির কারণে নষ্ট হলে আমরা ইতিহাসের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়তে পারি- সেই সতর্কতার জন্যই এই বিষয়ে কলম ধরা। চলমান সিরিজের সমালোচনা করার কোনো দায় আমাদের নেই। ইতিহাসকে কাছাকাছি টেনে আনার উদ্যোগটুকু তো সমর্থনযোগ্য। যা হয়নি তা না হয় আগামী দিনে হওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখল।