175349

সুন্দরী রোহিঙ্গা তরুণীদের নতুন বিপদ

ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নির্যাতনের শিকার রাখাইন-রোহিঙ্গারা। অত্যাচার থেকে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এদের মধ্যে নারী-শিশুই বেশি। এখানে এত মানুষের একসাথে বসবাসের জন্য রয়েছে নানা সঙ্কট। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বিব্রত করছে রোহিঙ্গা তরুণীদের নিরাপত্তার সঙ্কট। এখানেও কিছু খারাপ মানুষ তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। এসব নিয়ে লিখেছেন গোলাম আজম খান

মিয়ানমারের বুচিডং টমবাজার থেকে পালিয়ে এসে কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছেন তরুণী হামিদা। তার বাবাকে মিয়ানমারের সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। মা ও এক ছোট বোনের সাথে চার দিন আগে তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসেও স্বস্তিতে নেই হামিদা ও মা আলেয়া খাতুন। সুন্দরী হওয়ায় কিছু লম্পট তাকে ঘিরে রয়েছে। একই সাথে দালালও তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তিন দিন ধরে নানাভাবে হামিদা ও তার মাকে ফুঁসলাচ্ছে লম্পট ও দালালেরা। নানাভাবে লোভও দেখাচ্ছে। তারা হামিদাকে কুপ্রস্তাবও দিয়েছে। বিনিময়ে টাকা দেবে বলে প্রলোভন দেখাচ্ছে। শুধু লম্পট যুবকেরা নয়, কয়েকজন দালালও হামিদার মাকে টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। তরুণী হামিদাকে তারা হোটেলে রাখবে। বিনিময়ে অনেক টাকা দেবে। হামিদা বলেন, ‘বাবাকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি। নিজের প্রাণ বাঁচাতে চরম আতঙ্ক নিয়ে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই। প্রতিনিয়ত লম্পটদের কালো হাত তাড়া করছে। এই আতঙ্কের কারণে একটুও শান্তি পাচ্ছি না।

মা আলেয়া খাতুন বলেন, ‘নিজ দেশ ছেড়ে জান বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি। সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেও বিপদ পিছু ছাড়ছে না। আমার খুব ভয়, না জানি মেয়েটা হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই রাত-দিন মেয়েকে নিজ হাতে ধরে রেখেছি।’ এমন ঘটনা শুধু হামিদার নয়- অনেকেই এর ভুক্তভোগি।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের হামলার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশই অবিবাহিত তরুণী। এসব তরুণীর মধ্যে অনেক সুন্দরী তরুণী রয়েছেন। তারা সবাই বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে ঠাঁই নিয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে এলেও এসব তরুণী শান্তিতে নেই। প্রতিনিয়ত তাদের তাড়া করছে এ দেশীয় লম্পট ও দালালদের কালো হাত। এ নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রোহিঙ্গা তরুণীরা। নিরাপত্তাহীনতা তাদের পরিবারকেও ভাবিয়ে তুলেছে বলে জানা গেছে।
দলে দলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নানাভাবে প্রত্যক্ষ করে জানা যায়, ভাড়া নিয়ে দালালদের বিড়ম্বনা, টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল সেট কেড়ে নেয়া, গরু-ছাগল-মহিষ লুট করা, পানি-খাদ্য সঙ্কট ইত্যাদির পাশাপাশি চরম সমস্যায় ভুগছেন রোহিঙ্গা তরুণীরা।

যেসব মা অথবা বাবার কাছে সুন্দরী তরুণী রয়েছে তারা চরম নিরাপত্তা সঙ্কটে ভুগছেন। মা-বাবার চেয়েও বেশি আতঙ্কে রয়েছেন সুন্দরী তরুণীরা। পালিয়ে আসা তরুণীদের মধ্যে বেশির ভাগেরই কোনো-না-কোনো আত্মীয় হত্যার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে তারা শোকের সাগরে ভাসছেন। তার ওপর লম্পটদের হানা তাদেরকে অসহায় করে তুলেছে।

জানা যায়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতায় কাজ করছেন স্থানীয় লোকজন। এ ছাড়া দূর-দূরান্ত থেকেও লোক গিয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছেন। কিন্তু কিছু স্থানীয় দুষ্টু লোক রোহিঙ্গাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের গরু-ছাগলসহ নানা জিনিসপত্র লুট করছে। একইভাবে সুন্দরী রোহিঙ্গা তরুণীদের ওপর কুনজর দিয়েছে স্থানীয় কিছু লম্পট শ্রেণীর লোক ও পতিতার দালালেরা। তারা সুন্দরী রোহিঙ্গা তরুণীদের টার্গেট করে নানাভাবে কুপ্ররোচনা দিচ্ছে। ভাগাতে না পেরে অপহরণ পর্যন্ত করছে। অন্য দিকে, পতিতার দালাল চক্রও টার্গেট করেছে সুন্দরী রোহিঙ্গা তরুণীদের। তারা অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তরুণী ও তাদের পরিবারকে ফুঁসলাচ্ছে। এতে নিরাপত্তা সঙ্কট ভুক্তভোগীদের কুরে কুরে খাচ্ছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সংখ্যা খুব অপ্রতুল হওয়ায় নিরাপত্তার প্রকট সঙ্কট বিরাজ করছে। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারিও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

‘‌এই মিলিটারি সেই মিলিটারি না’
গোলাম আজম খান, কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা
নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের মুখে খাকি পোশাক, বুট জুতা আর অস্ত্রধারী মিয়ানমার মিলিটারির (রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীকে মিলিটারি বলে জানে) নৃশংসতার বর্ণনা শুনে সবাই কেঁদেছে। অপরদিকে সরকারি আদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শনিবার সকালে পৌঁছে কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। কাঠফাঁটা রোদে পলিথিনের ঝুপড়িতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন সবাইকে ব্যথিত করেছে।

পোশাকি মিল থাকলেও প্রত্যেক দেশের সেনাবাহিনী যে একই চরিত্রের নয়, তা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অমানবিক বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার মানুষগুলো এখন দেখছে অন্য এক রকম সেনাবাহিনী।

শনিবার হঠাৎ সেনা সদস্যরা শরণার্থী শিবিরে ঝুপড়িগুলো পরিদর্শন করার সময় অনেক রোহিঙ্গা নারী ও শিশু ভয় পেয়ে যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্মমতার স্মৃতি তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে ভয় পেয়েছে তারা। অবশ্য বাংলাদেশ সেনা সদস্যদের ভালোবাসা ও সুন্দর করে কথা বলা দেখে ভুল ভাঙে রোহিঙ্গাদের। খাকি পোশাক, পায়ে বুট জুতা, আর কাঁধে ঝুলানো অস্ত্র থাকলেই যে নির্যাতন করবে এমন চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে । শনিবার থেকে সেনাবাহিনীর সমাদর, সহযোগিতা ও ভালোবাসা দেখে আপ্লুত তারা। কেউ কেউ বলছেন এই মিলিটারি সেই মিলিটারি না।

নিজ দেশে বাস্তুুুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার উখিয়ায় যে ২ হাজার একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে সেনাবাহিনী ১৪ হাজার শেড তৈরি করবে। এসব শেডের প্রতিটিতে ছয়জন করে ৮৪ হাজার পরিবারকে বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হবে। শেড নির্মাণের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সেনাবাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা এটি করছে।

এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে চলমান প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর কোথায় কি করতে হবে তা নির্ধারণ করে তারা ফিরে যান। শনিবার দুপুরে ৩৬ বীর, ২৪ বেঙ্গল ও ৬৩ বেঙ্গল নামে তিনটি টিম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় স্থল উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী আসে।

সেনাদের ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার এসপি জানান, পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে সেনা সদস্যরা প্রথমে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ শুরু করে। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বিচ্ছিন্ন ত্রাণ বিতরণ এবং রাস্তায় রোহিঙ্গাদের অহেতুক জটলা সরিয়ে দিয়ে সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কন্ট্রোল রুমে জমা হওয়া দ্রুত পচনযোগ্য তাজা খাবারগুলো আলাদা করে বিতরণের জন্য নেয়া হচ্ছে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আসা রোহিঙ্গারাই এসব ত্রাণের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিকের সুবিধার মেসেজটা রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। যাতে কচ্ছপ গতি থেকে চলমান এ নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা খরগোশ গতিতে আসে।

কাজের সুবিধার্থে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিত্যক্ত একটি কক্ষকে কোম্পানির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার জানান, প্রথম দিন হিসেবে শুধু শৃঙ্খলা আনয়নে কাজ করেছি। রোববার থেকে একটি টিম শেড নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।

এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে ঢোকে রোহিঙ্গারা। মানবিকতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়ে সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। শুধু ত্রাণ দিলে হবে না তাদের জন্য সুষ্ঠু স্যানিটেশন ব্যাবস্থা, সুপেয় পানিসহ পরিচ্ছন্ন আবাসন দরকার। তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হবে। এটি স্থানীয়দের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই দ্রুততার সঙ্গে শৃঙ্খলভাবে কাজ সম্পন্ন করতে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছি।

জেলা প্রশাসক জানান, সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিককরণে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার কাজ করবে। পাশাপাশি শৃঙ্খলার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণেও কাজ করবে সেনাবাহিনী। এ কারণে সব ধরনের ত্রাণ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রদানের জন্য আবারও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সূত্র: নয়া দিগন্ত

ad

পাঠকের মতামত