175106

রোহিঙ্গাদের ৩টি ঐতিহাসিক ভুল যা সবার জানা দরকার


আজ আমরা মানুষ হিসাবে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছি। তাদের কষ্টে আমাদেরও প্রাণ কাঁদে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আজকের এই দুর্দশার জন্য মূলতঃ তাদের পূর্বপুরুষরাই অনেকাংশে দায়ী। ইতিহাসের তিনটি ভুল তাদের এই প্রজন্মকে সর্বনাশের রাস্তা তৈরী করে দিয়ে গেছে।

১ম ভুল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা সমর্থন করেছিল জাপানীদের। আর পুরো মায়ানমারের জনসমর্থন ছিল ব্রিটিশদের প্রতি। সে যুদ্ধে জিতেছিল জাপান। কিন্তু জাপান যখন চলে যায় রোহিঙ্গারা হয়ে পড়ে একঘরে। তারপর হতেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মায়ানমার এবং রোহিঙ্গাদের সাথে। এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তারা মায়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না রোহিঙ্গাদের নাম।

২য় ভুল

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মায়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মায়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

১৯৪৭ সালে তাদেরকে মায়ানমারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তখন রোহিঙ্গারা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সাথে থাকার কথা জানায়। পরে জিন্নাহ তাদেরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সেদিন জিন্নাহ তাদের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করলে আজ হয়তো আরকান রাজ্যটি বাংলাদেশেরই হতো। নতুবা আরেকটি ‘কাশ্মীর’ হতে পারতো।

রোহিঙ্গাদের দেশ বিভক্ত হবার এই ভুল সিদ্ধান্তই ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল। যার খেসারতই পরে ধুঁকে ধুঁকে দিতে হচ্ছে। যদি ওরা ওই সময়ে মায়ানমারের সাথে সম্পৃক্ত থাকতো তাহলে আজকের এই পরিণতি হতো না। পূর্বের ভুল থেকে হয়তো পরিত্রান পেতো। তারপর থেকেই মায়ানমার লোকজন তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকলো। তখন থেকেই ক্রমশ: মায়ানমারে সংকুচিত হতে থাকে রোহিঙ্গাদের অধিকার।

১৯৬২ সালের পর থেকেই মায়ানমারের সামরিক বাহিনী শুরু করে তাদের উপর জুলুম নির্যাতন। রোহিঙ্গাদের কপালে নেমে আসে অমাবশ্যার অন্ধকার। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সে দেশের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো তাদের। এক সময় মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের লোক হিসাবে অস্বীকার করতে লাগলো। বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের ‘বহিরাগত’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মায়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

৩য় ভুল

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে সময়ে রোহিঙ্গারা আরেকটি ভুল করে বসে। মায়ানমারের এই রোহিঙ্গারা মুসলমান হিসাবে সমর্থন করলো পাক হানাদার বাহিনীকে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙ্গালীর সহানুভূতিও হারিয়ে ফেলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ জন্মের পর এই রোহিঙ্গারা একূল অকূল দু’ কূলই হারায়। ইতিহাসের ঘূর্ণিপাকে দু’ কূল হারিয়ে অথৈ সাগরে ভাসতে লাগলো ওরা। মায়ানমার মানুষের কাছে পরিচিত হতে থাকলো এক ‘বেঈমান জাতি’ হিসাবে।

আধুনিক বিশ্বে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায় একটি পশ্চাৎপদ জাতিগোষ্ঠী। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে। যার কারনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অশিক্ষিতের হার সবচেয়ে বেশী। অনেকেই এখনো জন্মনিন্ত্রন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনাও নেই। ইতিহাসের সেই নদী পার হয়ে এভাবেই ভাসতে ভাসতে ওরা আজ বাংলাদেশের শরনার্থী। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে বাংলাদেশ জন্মের বিরুদ্ধে ছিল ওরা। আজ সেই বাংলাদেশেই বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল হলো।

পূর্ব পুরুষদের সেই তিনটি ভুল সিদ্ধান্ত বা বেঈমানীরই প্রায়শ্চিত্য ভোগ করছে আজকের রোহিঙ্গারা। ওদের ভবিষ্যত আজো অনিশ্চিত। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মাত্র একটা ভুল করলে আমাদের আগামী প্রজন্মকেও এর চরম মূল্য দিতে হবে। উদ্বেগের বিষয় যে, ১৪ লাখ রোহিঙ্গার প্রায় ৭ লাখই এখন বাংলাদেশে। যা কক্সবাজার, উখিয়া এলাকার জনসংখ্যার চেয়ে বেশী। বাকীরা মায়ানমার, সৌদি, লন্ডন, কানাডা, মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

তথ্যসূত্র: Myanmar independence history page, Wikipedia

ad

পাঠকের মতামত