গভীর রাতে মায়ের কাছে তরুণীর ফোন, ‘মা আমারে বাঁচাও…
গভীর রাতে মায়ের কাছে তরুণীর ফোন।‘মা আমারে বাঁচাও, নিয়া যাও। ওরা আমারে মাইরা ফেলার পরই কী তোমরা আইবা।’এমন আকুতির ১১ঘন্টা পরই মিলল তরুণী তমার লাশ।
শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তমার মা মেয়ের নিথর দেহ জাপটে ধরে জানান,‘বিয়ার সাড়ে ৩ বছরে যৌতুকের জন্য অনেক নির্যাতন সহ্য করছে মা আমার। জমি বেইচ্চা হইলেও হেগোরে ৫ লাখ টাকা দেবার কইছিলাম। জোগার করতে পারি নাই বইল্লা মারে একবারের জন্য দেখাও করতে দেয়নি জামাইরা। বাসায় আটকাইয়া খালি মারত। তমা মাঝে মধ্যে মোবাইলে কথা কইতো, তাও লুকায়া।
বৃহষ্পতিবার রাত একটার দিকেও মায়ের কাছে ফোন কইরা কইছিলো ‘মা আমারে বাঁচাও, নিয়া যাও। ওরা আমারে মাইরা ফেলার পরই কী তোমরা আইবা।’ ওর আকুতি শুইন্না শুক্রবার মাইয়াডারে নিতে আসতে চাইছিলাম। কিন্তু এর আগেই তমারে মাইরা ফেলল হেরা। মাইয়াডার লাশ নিয়া কেমনে আমি দেশে যামু। লাশের ভার আর সহ্য হচ্ছে না ভাই।’
জানা গেছে, তমার স্বামী কাজী মুন্না একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ডিলার। বিয়ের কিছুদিন পর তমার মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন তিনি। দিতে না পারায় মুন্না আর তার মা প্রতিনিয়ত নির্যাতন করত তমাকে। বৃহস্পতিবার রাতে মেয়ের ফোন পেয়ে এই অত্যাচারের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে তাকে নিয়ে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তমার বাবা নজরুল ইসলাম। এর মধ্যেই তমার শশুর কাজী মাসুদুর রহমান ফোন করে তশার বাবাকে জানান, তমা অসুস্থ। তাড়াতাড়ি আসেন। ঢাকায় এসে তারা দেখতে পান মেয়ের নিথর দেহ।
নজরুল ইসলাম জানান, তার মেয়ে তমা খুবই মেধাবী ছিলেন।এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ এবং পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতেও বৃত্তি পেয়েছিলো। এছাড়া ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো সে। তমা কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। অমানুষিক নির্যাতনের পর তমাকে তার স্বামী ও শাশুড়ি হত্যার পর এখন বলছে, আত্মহত্যা করেছে।
কিন্তু আত্মহত্যার কোন আলামত নেই মরদেহে। উপরন্তু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া আলামত নষ্ট করতে পুলিশ ছাড়াই তারা তমার মরদেহ উদ্ধার করে। এখন মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তারা বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। মেয়ের এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তমার বাবা। রাতেই গোপালগঞ্জ কোটালিপাড়ার পূর্ণবতি গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তমার লাশ দাফন করবেন বলে জানান তার বাবা।
পিঠের মাঝামাঝি হতে নীচের অংশে লালচে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে উল্লেখ করে তমার মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন গেণ্ডারিয়া থানার এসআই সৈয়দ আব্দুল মন্নান। অভিযুক্তদের ভাষ্য এবং প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে সুরতহালে তিনি উল্লেখ করেন, পারিবারিকভাবে ৩ বছর ৯মাস আগে বিয়ে হয় ওই দম্পতির। বিয়ের পর থেকেই মৃতার শাশুড়ির সঙ্গে তেমন বনিবনা হচ্ছিল না। প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হত। গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্বামী ও শাশুড়ির সঙ্গে তমার ঝগড়া হয়। তাদের অন্যায়
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বেলা সোয়া ১১টার দিকে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে ওরনা দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস নেন তমা। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তমার দরজা বন্ধ এবং কোনও সাড়া-শব্দ না পেয়ে দরজার লক ভেঙ্গে কাজী মুন্না তমাকে উদ্ধার করে। অচেতন অবস্থায় তাকে আলী আজগর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তমাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তারা লাশ বাসায় নিয়ে আসে।
এসআই মন্নান বলেন, থানার মাধ্যমে খবর পেয়ে শুক্রবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে তমার শশুরালয় থেকে তমার লাশ উদ্ধার করেন। এসময় তমার স্বহস্তে লেখা ডায়েরিসহ কিছু আলামতও জব্দ করেন তিনি।
গেণ্ডারিয়া থানার ওসি কাজি মিজানুর রহমান বলেন, ওই গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। ঘটনায় অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে এবং আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ওই গৃহবধুর সঙ্গে কি ঘটেছিলো তা জানা যাবে।
উল্লেখ্য, রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় কাজী তমা (২০) নামে এক গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেলে গেণ্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের ৪৬ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় শ্বশুরালয় থেকে তমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযুক্ত তমার স্বামী কাজী মুন্না ও তার মা বেনু বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।