ঢাকায় আসছে বন্যা
রাজধানী ঘিরে ফেলেছে বন্যা। দ্রুত বাড়ছে ঢাকার চারপাশ ঘেরা চার নদ-নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার পানি। সবচেয়ে বেশি বিপদের ডাক শোনা যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল বুধবারের পূর্বাভাস সত্যি হলে আগামীকাল শুক্রবার থেকেই ঢাকাসংলগ্ন শীতলক্ষ্যার পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পরবর্তী তিন-চার দিন তা আরো বাড়তে থাকবে। ওই কেন্দ্রের বন্যা মানচিত্রে পানির স্তর নির্ধারণী চিহ্নে এমনই অবস্থান দেখানো হয়েছে। এমনকি শীতলক্ষ্যার লাখপুর প্রান্তে গতকালই পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে উঠে গেছে, যা নারায়ণগঞ্জ ছাপিয়ে সহজেই যেকোনো সময় ঢাকায় ঢুকে পড়বে পূর্ব দিক দিয়ে। কারণ বড় ঝুঁকির বিষয় হয়ে রয়েছে ঢাকার অরক্ষিত পূর্বাঞ্চল। ডিএনডি বাঁধ দিয়ে ঢাকার অর্ধেকটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও বাকি অর্ধেক ১৯ বছরেও আর আলোর মুখ দেখেনি। নানা অজুহাতে চাপা পড়ে আছে এসংক্রান্ত প্রকল্পটি, যা এবার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের লাখো মানুষের জন্য। বন্যা বিশেষজ্ঞরাও এমন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন বন্যা মোকাবেলায় ঢাকার দায়িত্বশীল সব কর্তৃপক্ষকে যার যার ক্ষেত্র থেকে সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেওয়ার।
পদ্মার পানি উঠে গেছে বিপৎসীমার ওপরে। আশপাশের সব নদ-নদীর পানিই বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঢাকার পাশের জেলা নরসিংদী ইতিমধ্যেই বন্যার কবলে পড়েছে মেঘনার পানি বেড়ে গিয়ে।
গতকাল রাত ৮টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার চারদিকের নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যদিও শীতলক্ষ্যা ছাড়া অন্যগুলোর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে আছে। অন্যদিকে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যার পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠছেই। এ ক্ষেত্রে সব কিছুই নির্ভর করছে আগামী দু-তিন দিন পানি উজান থেকে যমুনা হয়ে মধ্যাঞ্চল থেকে কতটা দ্রুত নেমে যেতে পারে তার ওপর। যদি পানি নামার গতি মন্থর হয় তবে যেমন ঢাকার জন্য বিপদ বয়ে আনবে তেমনি ওই বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে যদি আবার টানা বর্ষণ ও উজানের পানি বাড়তে থাকে।
গত কয়েক দিনে দেশের উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মধ্যাঞ্চলে পানি থমকে থাকা এবং আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাবে সপ্তাহের শেষভাগে আরেক দফা ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস থেকে এবার ঢাকা বড় ধরনের বন্যায় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি জোরালো হচ্ছে, যা হয়ে উঠতে পারে ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ কিংবা ২০০৪ সালের মতো। এ ক্ষেত্রে অন্য সববারের মতোই বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকবে পূর্বাঞ্চলের অরক্ষিত বন্যাপ্রবণ এলাকা দিয়ে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ঢাকায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। একই কথা বলেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকাকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য সরকারের প্রস্তাবিত ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ নির্মাণের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। কিন্তু ১৯ বছর ধরে অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে ওই এলাকা। এবার পূর্বাঞ্চলীয় নিচু এলাকাগুলোতে পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেন্দ্রীয় জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. ফকরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরনো প্রকল্পটি নিয়ে আবার নতুন করে উদ্যোগ শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনায়। এরই মধ্যে একটি চায়নিজ প্রতিষ্ঠান নতুন করে সমীক্ষা শুরু করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে এই প্রক্রিয়ায় ইস্টার্ন বাইপাস প্রকল্পটি আব্দুল্লাহপুর থেকে ডেমরা পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্যা এলেই ঢাকায় যে উত্কণ্ঠা দেখা দেয়, পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধটি নির্মিত হলে সেই উত্কণ্ঠা দূর হবে। আমরাও জানি, বন্যা অবস্থা তৈরি হলে পূর্বাঞ্চল দিয়েও ঢাকায় পানি ঢুকে পড়ে। এবার বন্যা ঢাকায় আসতে যাচ্ছে—এমন আশঙ্কা মাথায় রেখেই আমরা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এখন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। আরো দু-এক দিন দেখে চূড়ান্ত অবস্থা বলা যাবে। ’
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুসারে গতকাল পদ্মার গোয়ালন্দে পানি বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও ভাগ্যকুলে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে ধলেশ্বরীর এলাসিন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ পড়েছে বন্যার কবলে। এ ছাড়া একই সূত্র অনুসারে দেশের অন্য সব এলাকায় বন্যার কিছুটা উন্নতি হলেও বা কিছু নদ-নদীর পানি কমলেও পদ্মার পানি আগামী ৭২ ঘণ্টা বাড়তে থাকবে।
কেন্দ্রের ৯০টি পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুসারে গতকাল ৬০টি পয়েন্টের পানি বিভিন্ন হারে বেড়েছে এবং ২৬টি নদীর পানি আগের তুলনায় কমেছে। অন্যদিকে ৩৯টি পয়েন্টের পানি রয়েছে বিপৎসীমার ওপরে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. সেলিম ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই-তিন দিন ধরে তুলনামূলক বৃষ্টি কম থাকায় বন্যার পানির টানা ঊর্ধ্বগতি কিছুটা থেমেছে। কিন্তু অমাবস্যা এবং এর পরপরই আবারও ভারি বর্ষার পূর্বাভাস রয়েছে। অমাবস্যার প্রভাবে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেশি থাকে। ফলে বন্যার পানি যেমন সহজে সমুদ্রে নেমে যেতে পারবে না, তেমনি ভেতরের সব নদ-নদীতেও বাড়তি জোয়ার থাকবে। যার সঙ্গে বন্যার পানি যুক্ত হয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হবে, সেই সঙ্গে যোগ হবে ভারি বৃষ্টির পানি।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের কারণে ঢাকার একাংশ সুবিধা পেলেও বেশির ভাগ এলাকা থেকে গেছে অরক্ষিত। এ কারণে ১৯৯৮ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্পটির পরিকল্পনা করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রথমবারের প্রস্তাবে দুই হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ের প্রকল্পটি তখনই একনেকে অনুমোদন করা হয়। এই টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত শ কোটি টাকা রাখা হয় শুধু বাঁধ নির্মাণের জন্য। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ আরো একাধিক দাতা সংস্থা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখায়। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নানামুখী সমীক্ষা চলে অনেক দিন। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার টাকা না পাওয়ার অজুহাতে প্রকল্পটি স্থগিত করে দেয়। এর পর থেকে প্রতিবারই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। ব্যয় পরিধিও সম্প্রসারিত হয়। তবে আগ্রহী দাতা সংস্থাগুলো পিছটান দেওয়ায় এই প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে ওই প্রকল্প নতুন এক বৃহত্তর প্রকল্পের আওতায় নিয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে এর সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা ধরে নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেন্দ্রীয় জোনের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, “প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ড একা বাস্তবায়ন করবে না। আরো বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থাকে যুক্ত করে একটি ‘আমব্রেলা প্রজেক্ট’ করা হবে। এটা অনেক বড় একটি প্রকল্প হওয়ায় সরকারকে অনেক দিক বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। তবে এবার আমরা আশা রাখি, প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে। ”
সূত্র: কালের কন্ঠ