বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পৌনে ৬ লাখ মানুষ
চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার বন্যায় এ পর্যন্ত ২০ জেলার পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জানিয়েছেন।
এসব এলাকার তিন লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৬ জন মানুষকে ৯৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বন্যার সবশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে মারাত্মক বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে।
“আমরা উজানের দেশের বন্যা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছি। উজানের দেশগুলোতে বন্যা হলে ভাটির দেশ হিসেবে উজানের প্রভাব আমাদের উপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।”
মন্ত্রী জানান, সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোণা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিসহ ২০ জেলার ৩৫৬টি উপজেলার ৩৫৮টি ইউনিয়ন দ্বিতীয় দফার এই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
গত তিন দিনে পানিতে ডুবে, ভেসে গিয়ে বা সাপের কামড়ে ২৭ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে কেবল দিনাজপুরেই ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া কুড়িগ্রামে ১১ জন এবং লালমনিরহাটে তিনজনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
দিনাজপুরে পুণর্ভবা নদীর পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যায় দুর্ভোগে আশপাশের বাসিন্দা। ছবিটি রোববার তোলা। এবার বর্ষা মৌসুমে মধ্য জুলাইয়ে প্রায় একডজন জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটলে সাড়ে ছয় লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
মাঝে কয়েকদিন বিরতি দিয়ে অগাস্টের শুরু থেকে দ্বিতীয় দফার এই বন্যা শুরু হয়, যাতে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৬৯টিতে সোমবার সকালেও পানি বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত ছিল।
এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও কংস বিপদসীমার উপরে বইছে।
দুর্গত জেলাগুলোর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। রেলপথে সারা দেশে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে গেছে দিনাজপুর জেলা।
দিনাজপুর শহরের বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার পানি আগামী ৭২ ঘণ্টা এবং সুরমা-কুশিয়ারার পানির উচ্চতা আগামী ২৪ ঘণ্টা বাড়তে পারে।
একই সময়ে তিন অববাহিকায় পানি বাড়ার কারণে উত্তরাঞ্চল থেকে বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে।
অগাস্টের শেষে ফের ভারি বর্ষণ হলে সেপ্টেম্বর নাগাদ অন্তত ২৫ জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটতে পারে।
>> গত কয়েক দশকে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, তখন ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল।
>> ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় ৬১ শতাংশ এলাকা। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
>> ২০১৩ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতে মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, “উত্তরাঞ্চল থেকে পানি নামার সময় মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মারদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও ভোলা জেলা প্লাবিত হতে পারে। পানি এলে ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও আমরা দেখছি।”
তিনি জানান, দুর্গত হয়েছে এবং হতে পারে এমন ৩৩টি জেলায় ১০ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন চাল ও তিন কোটি ১০ লাখ টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রোববার মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এবং সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যেসব অঞ্চলে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে সেসব এলাকার সংসদ সদস্যরা ইতোমধ্যে এলাকায় চলে গেছেন এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয় সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
“মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কোথায় কী প্রয়োজন, সেভাবেই আমরা চাহিদা মেটাচ্ছি।”
মায়া বলেন, বন্যার এই দুর্যোগ মাসখানেক স্থায়ী হতে পারে এবং শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত সরকারের তৎপরতা চলবে।
“আমাদের হাতে খাদ্যের কোনো অভাব নাই, পর্যাপ্ত খাবার আছে।… এ ধরনের পরিস্থিতির (বন্যা) সম্ভাবনা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে খাদ্য আমাদানি করতে শুরু করেছেন এবং ইতোমধ্যে আসা শুরু হয়েছে। খাদ্যাভাব হবে বলে আমার মনে হয় না। আমরা সেটা মোকাবিলা করতে পারব।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, উদ্ধারকারী যানবাহন ও নৌকা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“জিআরের টাকা দিয়ে নৌকা কিনতে বলা হয়েছে। কয়েক জায়গায় উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, বিজিবি এবং সেনা বাহিনীর সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে।”
আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষ বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত যাতে খাবার ও অন্যান্য সহযোগিতা পানম সে ব্যবস্থাও নেওয়ার কথা বলেন রিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ টান খাদ্যশস্য আনার প্রক্রিয়া চলছে, আরও খাদ্যশস্য আনা হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মন্ত্রীর সঙ্গে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।