হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পিটিয়ে হত্যার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে?
ভোর বেলা বাড়িতে এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে মানুষ হত্যা করার ক্ষমতা পুলিশকে কি সরকার দিয়েছে? এ প্রশ্ন পুলিশের পিটুনিতে নিহত রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ বালাটারী এলাকার নুরুন্নবীর স্ত্রীর।
নুরুন্নবীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে পুলিশ। রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান স্বীকার করে বলেন, “নুরুন্নবী পুলিশ হেফাজতেই মারা গেছেন। ঘটনাটি তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
এদিকে, নিহতের পরিবারও দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেছেন।
নুরুন্নবীর স্বজনরা দাবি করেছেন, জোর করে ৮০ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার পরেও তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে পুলিশ।
শনিবার বালাটারী মহল্লায় নুরুন্নবীর বাড়িতে গেলে দেখা যায় আহাজারি করছেন তার স্বজনরা। তাদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে এসেছেন স্থানীয়রা।
নুরন্নবীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ তার স্ত্রী আরজিনা বেগম। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমার স্বামীর হংকং যাওয়ার কথা ছিল। তার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র ঠিক করা হয়েছে। এ জন্য বেশ কয়েকদিন সে ঢাকায় ছিল।
আরজিনা আরও জানান, পুলিশ আজ শনিবার (২০ আগস্ট) ভোরে যখন তাদের বাসায় আসে তখন তিনি নিজেই কোতোয়ালী থানার এস আই তারেককে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেছেন। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জানান, একটি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় নুরুন্নবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন তারা। সিসিটিভিতে নাকি ফুটেজ আছে। এ সময় সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চান নুরুন্নবী। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা সিসিটিভির ফুটেজ নাই জানিয়ে বলেন, মোটরসাইকেল চোর তার নাম বলেছে।
আরজিনা বেগম আরও জানান, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে পুলিশ তদন্ত করতেই পারে। তাই বলে বাসায় ভোরবেলা এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলে হাতে হ্যান্ড কাফ পরিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে মানুষ হত্যা করার ক্ষমতা পুলিশকে কি সরকার দিয়েছে? অভিযোগ থাকলেই কি এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করতে হবে? টাকা না দিলে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হবে? দাবি করা চাঁদার টাকা না পেয়েই পুলিশ নুরন্নবীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে নিহত নুরুন্নবীর ছোট ভাই গোলজার হোসেন বলেন, পুলিশ গভীর রাতে বাসায় এসে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কোনও কথা না বলে হাতে হাতকড়া পরায়। এরপর বলে আমরা নাকি মোটরসাইকেল চুরি করেছি। এ সময় আমি বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যবসার কথা জানিয়ে দোকানের ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন কাগজ দেখাই। তারপরও পুলিশ কর্মকর্তা তারেক ও তোফাজ্জল বলেন ‘এক লাখ ২০ হাজার টাকা না দিলে মোটরসাইকেল চুরি মামলায় চালান করে দেবে’। বাধ্য হয়ে ৮০ হাজার টাকা এসআই তারেককে দেই। টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দেয়। বাকি ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য দুপুর পর্যন্ত সময় দেয় তারা। কিন্তু বড়ভাই নুরুন্নবীকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে তারা।
প্রত্যক্ষদর্শী মামুন জানান, এসআই তারেক তাদের সামনেই নুরুন্নবীকে কানে ঘাড়ের পেছনে দফায় দফায় থাপ্পড় মারেন। বুকের ওপর লাথি মেরেছেন। ফলে ঘটনাস্থলেই নুরুন্নবী মারা যান। অথচ পুলিশ পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে মৃত মানুষটিকে চিকিৎসার নামে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
এদিকে বালাটারী মহল্লার মানুষের দাবি, কোতোয়ালী পুলিশ টাকা নেওয়ার জন্য নুরুন্নবীদের বাড়িতে গিয়েছিল। তারাও নিশ্চিত করেন, ছোট ভাই গোলজার হোসেনের কাছে তারা ৮০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে এবং ৪০ হাজার টাকা দুপুরের মধ্যে দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় নুরুন্নবীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তারা দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দাবি করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বালাটারী মহল্লায় তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এদিকে কোতোয়ালী থানার ওসি এবিএম জাহিদুল ইসলাম জানান, যেহেতু পুলিশি হেফাজতে নুরুন্নবী মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে সে কারণে লাশের সুরতহাল একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করার পর ময়নাতদন্ত করা হবে। এ ঘটনায় দুপুর ২টা পর্যন্ত কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি বলেও ওসি জানান। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে রংপুরের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার জাকির হোসেনকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ৩ কার্য দিবসের মধ্যেই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানান পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। শনিবার দুপুরে নিজ দফতরে গণমাধ্যম কর্মীদের একথা জানান তিনি।
পুলিশ সুপার বলেন, তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে যাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তির দায় কখনই পুলিশ প্রশাসন গ্রহণ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।