বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার

bd-19-08-16-F-02দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কত? এ অস্ত্রগুলো কোথায় কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে— এমন সব প্রশ্নের সঠিক কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। এমনকি এর সুষ্ঠু মনিটরিংও হচ্ছে না। বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার অস্ত্রটি নিয়মনীতি মেনে ব্যবহার করছেন কিনা বা এগুলো সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে কিনা— তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্টদের।

আগ্নেয়াস্ত্রের মতো এমন স্পর্শকাতর মারণাস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েই কেবল দায়িত্বমুক্ত থাকছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে বৈধভাবে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটেই চলেছে। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর ব্যানারে নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে আদায় করে নিচ্ছেন অস্ত্রের লাইসেন্স। আর এ বৈধ অস্ত্র তারা খুনখারাবি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হত্যার হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনায় ব্যবহার করছেন। এমনকি ভাড়ায়ও পাওয়া যাচ্ছে এসব বৈধ অস্ত্র।

বিগত সাত বছরে নতুন ১০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেক দাগি অপরাধীও রয়েছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তবে বাতিল করা হয় মাত্র ১৫৬টি লাইসেন্স। তদন্ত হচ্ছে আরও ১৬২টির বিরুদ্ধে।

পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ হাদিস উদ্দিন বলেন, কারা কীভাবে অস্ত্রগুলো নিয়েছে এবং এগুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে আছে কিনা তা যাচাই করা দরকার। কেউ ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে নিয়ে থাকলে বা অস্ত্রের লাইন্সেস পাওয়ার যোগ্য নয় এমন ব্যক্তির কাছে অস্ত্র থাকলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এসব লাইসেন্স বাতিল করে অস্ত্রগুলো সরকারের জমা নেওয়া দরকার। তা না হলে এসব অস্ত্র একসময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তার প্রোফাইল তৈরির কাজ চলছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৫২ সালে পাওয়া অস্ত্রের লাইসেন্সও রয়েছে।

সূত্র জানায়, খসড়া হিসাবমতে দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় সোয়া ২ লাখ। এর মধ্যে ২০ হাজার অস্ত্রের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, কোনো সরকারের আমলেই নীতিমালা মেনে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক তদবিরে যাকে-তাকে দেওয়া হয়েছে লাইসেন্স; এখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অসংখ্য আবেদন জমা পড়ে আছে।

র‌্যাবের এডিজি কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, ‘বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের সংবাদ অনেক সময় আমরা পাই। তখন আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই।’ কিছুদিন আগে র‌্যাব-৩ সেগুনবাগিচা থেকে বৈধ অস্ত্রসহ এক সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বৈধভাবে নেওয়া এসব অস্ত্র আসলে কীভাবে, কারা ব্যবহার করছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে নেই। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব ও জেলা প্রশাসকের কাছেও নেই।

সূত্র জানায়, গত সাত বছরে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। একই সময়ে অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য সারা দেশে প্রায় ৫০০ বৈধ অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ৩১৮টির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ অস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, কোনো নিয়ম-কানুন ছাড়াই অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে। অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হলে যার-তার কাছে অস্ত্র চলে যেত না। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে কঠোর নিয়মগুলো মানা হচ্ছে না। লাইসেন্স পাওয়ার একটি শর্তের মধ্যে বছরে ৩ লাখ টাকা আয়কর রিটার্ন দাখিলের যে বিধিটি রয়েছে তাও মানা হচ্ছে না।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, বৈধ অস্ত্রও দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখন বৈধ-অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে তার প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নূর হোসেন। দুই ডজন হত্যা মামলার আসামি নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের নামে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল নয়টি।

গোয়েন্দাসূত্রে জানা যায়, বৈধ অস্ত্রের অপব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় লাইসেন্স দেওয়াসহ অস্ত্র ব্যবস্থাপনা কড়াকড়ি করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। পরে একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করা হয়। নীতিমালা সংশোধনের পরও অনেক অযোগ্য লোক অস্ত্রের লাইসেন্স পাচ্ছে। বিশেষ করে অপরাধীরা দলীয় পরিচয় কাজে লাগিয়ে সহজেই অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে নিচ্ছে। বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লাইসেন্স নেওয়ার সময় যে ঠিকানা দেওয়া হচ্ছে, ওই ঠিকানারও হদিস মিলছে না।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেসব অস্ত্রের হিসাব মিলছে না সেগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। অনেক কিলার বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। অস্ত্রের মালিক ও হস্তান্তরের ব্যাপারে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।’ বৈধ অস্ত্রে অপরাধ : লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মানুষ হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর মিরপুরে নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি করার সময় দেলোয়ার হোসেন নামে এক সন্ত্রাসীকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে পুলিশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেলোয়ার নিজেকে আমদানি-রপ্তানিকারক পরিচয় দিয়ে ২০০৯ সালে অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। অস্ত্রের জন্য আবেদন ফরমে তিনি যেসব তথ্য ব্যবহার করেছিলেন তার সবই ছিল ভুয়া। এমনকি তিনি যে টিন সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তাও ছিল নকল। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শ্রাবণ এন্টারপ্রাইজের ঠিকানায় গিয়ে পুলিশ জানতে পারে ওই নামে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই। গুলশানে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল ও তারেক তাদের লাইসেন্স করা অস্ত্র ব্যবহার করেন বলে র‌্যাবের দাবি। তারেক এরই মধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। ঢাকায় বিএনপির সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম সেন্টু এখন আওয়ামী লীগের নেতা। কয়েক বছর আগে ফতুল্লায় বিসিক শিল্পনগরীতে এক মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ফতুল্লার পঞ্চবটী মোড়ে বৈধ অস্ত্র দিয়ে ট্রাফিক পরিদর্শককে ধাওয়া দিয়েছিলেন তিনি।

২০০৮ সালের ২৩ মে রাজধানীর ওয়ারীতে আশিকুর রহমান অপু হত্যাকাণ্ডে চারটি বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল। গ্রেফতারকৃত রমজানের কাছ থেকে তিনটি বৈধ অস্ত্র উদ্ধারও করেছিল পুলিশ। সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরীর বাসায় তারই শটগানের গুলিতে আহত হন পৌর প্যানেল মেয়র সেলিম আহমেদ, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম হায়দার ও পৌর কর্মচারী আল আমীন। ২০১২ সালের এপ্রিলে নড়াইলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রবিন তার বৈধ অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিলেন বিদ্যুৎ অফিসে। এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ ছাড়া শাসক দলের এমপি পিনু খানের ছেলে রাজধানীর মগবাজারে বৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন নিরীহ দুই পথচারীকে।

যেভাবে দেওয়া হয় লাইসেন্স : পিস্তল, রিভলবার ও শটগানের লাইসেন্স দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। অন্যদিকে বন্দুকের লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। এক ব্যক্তির নামে সর্বোচ্চ দুটি লাইসেন্স থাকার বিধান রয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, পেশা, বার্ষিক আয়, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর দাখিল করতে হয়। আবেদনকারীর নাম-ঠিকানা, পেশাসহ জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াও অতীত অপরাধের রেকর্ড যাচাই করে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এসব বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসী বা ফৌজদারি আইনে সাজাপ্রাপ্ত কোনো অপরাধীকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম নেই।

অস্ত্রের হিসাব মেলাতে কমিটিও ব্যর্থ : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে জোট সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় জমা পড়া অস্ত্র ও লাইসেন্সের বিপরীতে কেনা অস্ত্রের তথ্যে ব্যাপক গরমিল ধরা পড়ে। তখনই সরকার অস্ত্রের প্রকৃত হিসাব বের করতে কয়েকটি কমিটি গঠন করেছিল। বৈধ অস্ত্রের হিসাবে গরমিলের জন্য চারটি কারণ চিহ্নিত করে সেসব কমিটি। কারণগুলো হচ্ছে— অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন না করা সত্ত্বেও বছরের পর বছর লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া, লাইসেন্স প্রদানকারী জেলা কর্তৃপক্ষের দফতরে নবায়ন না করে অন্য জেলায় নবায়ন করা, স্বাধীনতার আগে অবাঙালিদের নামে দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল না করা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যবহূত বেহাত হয়ে যাওয়া বৈধ অস্ত্রের তালিকা তৈরি না করা। কারণ উদ্ঘাটনের পাশাপাশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে কিছু সুপারিশও করে কমিটি। তবে ওই সুপারিশ আমলেই নেয়নি তখনকার সরকার।

ad

পাঠকের মতামত