কারাগারেই গাভীর খামার জমিয়েছেন এক ডিআইজি প্রিজন

DIG Prison Touhid খামারে শুধু কারারক্ষী নিয়োগ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি ডিআইজি প্রিজন তৌহিদুল ইসলাম। এখানেই শেষ নয়, খামারে থাকা গাভী ও ছাগলের খাবারের জোগানও দেয়া হয় কারাগার থেকে।  খামার থেকে প্রতিদিন যে দুধ সংগ্রহ করা হয় তা কিনতে বাধ্য করা হয় কারা অভ্যন্তরে থাকা কর্মকর্তাদের…

নিয়মানুযায়ী কারারক্ষীর দায়িত্ব পালন করার কথা কারাগারে। কিন্তু সিলেট কারাগারের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।

এখানকার কারারক্ষীদের মধ্যে দু’জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন ডিআইজি প্রিজন (কারা উপ-মহাপরিদর্শক) তৌহিদুল ইসলামের ব্যক্তিগত গাভীর খামারে। এ খামারের খাবারের জোগানও দেয়া হয় কারাগার থেকে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ডিআইজি প্রিজনের নামে এখানে নানা খাত থেকে মাসোয়ারা তোলা হয়। রয়েছে বদলি বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগও। আর এসব অভিযোগ করেছেন খোদ কারাগারের কয়েকজন কর্মকর্তা।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, ডিআইজি প্রিজনের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

সিলেট কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের উল্টো দিকেই ডিআইজি প্রিজন ও অন্য কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবন। প্রাচীরের বাইরে সাঁটানো আছে ‘সংরক্ষিত এলাকা’র সাইনবোর্ড। অপরিচিত কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হয় না। সার্বক্ষণিক পালা করে দায়িত্ব পালন করেন কারারক্ষীরা। শহরের বারুতখানা এলাকায় কয়েক একর জমিতে কারা কর্মকর্তাদের এ আবাসস্থল। তবে ডিআইজি প্রিজন যে বাড়িতে থাকেন সেটি আলাদা। গাছগাছালিতে ভরপুর। এ বাড়ির পেছনেই তৌহিদুল ইসলাম ১০টি গাভী নিয়ে গড়ে তুলেছেন খামার। আড়াই বছর ধরে চলছে তার এ খামার।

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুরুর দিকে দৈনিক ভিত্তিতে তৌহিদুল ইসলামের খামারে বাইরের শ্রমিকরা কাজ করতেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই সেখানে নিয়োগ দেয়া হয় দুই কারারক্ষীকে। এরা হলেন- তারা মিয়া ও মো. সেলিম। যারা প্রতিদিন নিয়ম মেনে ডিআইজির গাভীর খামারের সার্বিক দেখভালের কাজ করেন। এরপর অনেকেই ভাবতে শুরু করেন, এটি হয়তো কারাগারের দুগ্ধ খামার। তবে বাস্তবতা হল, এটি ডিআইজি প্রিজনের ব্যক্তিগত দুগ্ধ খামার।

সূত্র বলছে, শুধু কারারক্ষী নিয়োগ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি ডিআইজি প্রিজন তৌহিদুল ইসলাম। খামার থেকে প্রতিদিন যে দুধ সংগ্রহ করা হয় তা কিনতে বাধ্য করা হয় কারা অভ্যন্তরে থাকা কর্মকর্তাদের। এখানেই শেষ নয়, খামারে থাকা গাভী ও ছাগলের খাবারের জোগানও দেয়া হয় কারাগার থেকে। কারাবন্দীদের জন্য যে ভাত রান্না করা হয় তার মাড়সহ ভাত সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০ কেজি চালের ভাত তৌহিদুল ইসলামের খামারে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কারারক্ষীরা। এভাবেই গাভীর পেটে যাচ্ছে বন্দিদের খাবারের অংশবিশেষ। ডিআইজির নির্দেশেই এভাবে কারাগারের খাবার যায় তার খামারে।

১১ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে সিলেট কারা ডিআইজির অফিসের সামনেই পাওয়া যায় কারারক্ষী সেলিম ও তারা মিয়াকে। এ সময় সেলিমের হাতে ছিল দুধের হিসাবসংক্রান্ত খাতা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কারারক্ষী তারা মিয়া। তবে তাদের দু’জনের পরনে তখন কারারক্ষীর পোশাক ছিল না।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, সকালের দুধ বিক্রির পর এই দুই কারারক্ষী নেমে পড়েন সাক্ষাৎ বাণিজ্যে। অর্থাৎ বন্দিদের সঙ্গে যারা দেখা-সাক্ষাৎ করতে আসেন তাদের একটি বড় অংশকে তারা টাকার বিনিময়ে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। ডিআইজির খামারে দায়িত্ব পালনকারী কারারক্ষী হওয়ায় অন্যরা তাদের সমীহ করে চলেন। আর এভাবে প্রতিদিন তাদের বাড়তি আয়-রোজগারও কম নয়।

অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন না করে এভাবে কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কাজ করেন কেন- জানতে চাইলে কারারক্ষী তারা মিয়া যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, ‘সবই তো দেখতে পাচ্ছেন। ডিআইজি স্যারের গাভীর খামারের কাজ শেষ করেই তো দিন শেষ হয়ে যায়, কারারক্ষীর কাজ কখন করব বলেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই খামার থেকে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ লিটার দুধ হয়। এগুলো বিক্রি করার দায়িত্বও তাদের। এছাড়া তাদের এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে কাজ করতে হয়। বড় স্যারের কাজ, না করে উপায় নেই।’

প্রসঙ্গত ২০১৩ সালের নভেম্বর ডিআইজি প্রিজন হিসেবে সিলেটে যোগদান করেন তৌহিদুল ইসলাম। এরপর থেকেই তার সরকারি বাসভবনের পেছনে টিন শেড দিয়ে তিনি গাভীর খামার গড়ে তোলেন। ১০টি গাভী রয়েছে তার খামারে। বেশ কয়েকটি ছাগলও আছে।

মাসোয়ারা আদায় : পদাধিকারবলে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার কারাগারের নিয়ন্ত্রণ করেন তৌহিদুল ইমলাম। তবে অভিযোগ রয়েছে, এ চারটি কারাগার থেকেই তৌহিদুল ইসলামের নামে মোটা অংকের মাসোয়ারা তোলা হয়।

ঘুষের এ টাকার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন সাবেক কর্মকর্তা (বর্তমানে অন্য একটি কারাগারে কর্মরত) যুগান্তরকে বলেন, ‘সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তৌহিদুল ইসলামকে দেয়া হয় দুই লাখ টাকা। এছাড়া সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা কারাগার থেকে এক লাখ টাকা করে আদায় করা হয়।

ওই কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতি তিন মাসে কারা ডিআইজি জেলা কারাগারগুলো পরিদর্শনের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু তৌহিদুল ইসলাম প্রতি মাসেই একবার করে জেলা কারাগার পরিদর্শনে যান। উদ্দেশ্য- বেঁধে দেয়া মাসোয়ারা নগদে আদায় করা। অগত্যা তার এ পরিদর্শন বন্দিদের কোনো উপকারে আসে না। বরং তিনি জেলা কারাগার পরিদর্শনে গেলে বন্দিদের ওপর হয়রানি ও অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা চেপে বসে। এর কারণ জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিআইজিকে মাসোয়ারা হিসাবে যে টাকা দেয়া হয় তা বন্দিদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়।

বদলি বাণিজ্য : নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারা কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলামের বদলি বাণিজ্যের বিষয়ে নানা তথ্য দেন। তিনি বলেন, পদাধিকার বলেই ডিআইজি প্রিজন তার নিয়ন্ত্রণাধীন কারাগারগুলোতে কারারক্ষীদের বদলি করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু টাকা ছাড়া কোনো বদলির প্রস্তাব অনুমোদন করেন না। একজন কারারক্ষীকে বদলি করতে নেয়া হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। এভাবে প্রেষণে কারারক্ষীদের একাধিক কারাগারে বদলি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বদলি বাণিজ্যের এসব টাকা তার পক্ষে কারাগারের করণিক কিরণ তালুকদার সংগ্রহ করেন। যে কোনো কারারক্ষী একটি কারাগারে অন্তত তিন বছর চাকরি করতে পারেন। কিন্তু ডিআইজি তৌহিদুল ইসলাম গত আড়াই বছরে বেশ কয়েকজন কারারক্ষীকে সময় শেষ হওয়ার অনেক আগেই বদলি করেছেন। আবার তৌহিদুল ইসলামের গাভীর খামারে কর্মরত কারারক্ষী তারা মিয়া আছেন বহালতবিয়তে। চার বছর পার হলেও তাকে বদলি করা হয় না।

সূত্র জানায়, কারা কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী সিলেট কারাগারের নানা খাতা থেকে প্রতি মাসে বিপুল অংকের টাকা তোলা হয়। তাই দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তারা এখানে বেশিদিন থাকতে চান। অবশ্য যে যতদিন থাকেন ততদিন তাকে মাসোয়ারা দিয়েই থাকতে হয়।

জানা গেছে, বর্তমান আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন দায়িত্বে আসার পর তার কঠোর নজদারির কারণে পোস্টিং বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তা সত্ত্বেও তৌহিদুল ইসলামের বদলি বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। জাকির হোসেন ওরফে লাইস জাকির নামে এক কারারক্ষীকে হবিগঞ্জ কারাগার থেকে সিলেট কারাগারে নিয়ে ক্যান্টিন পরিচালনা দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।

নিয়মানুযায়ী জেল সুপার ও জেলারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা কারা ক্যান্টিন। তৌহিদুল ইসলাম পিসি ক্যান্টিন তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করছেন। এখানেই শেষ নয়, ক্যান্টিন থেকে প্রতিদিন মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তরিতরকারিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে যান নিজের বাসায়।

ওদিকে নিয়মানুযায়ী ডিআইজি প্রিজন একজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি বাহার ও সিরাজ নামে দুই কারারক্ষীকে দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিষয়টি ওপর মহলে জানাজানি হলে একজনকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মহলবিশেষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচারে মাঠে নেমেছে। তিনি যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন তারাই এসব করছেন।  তিনি দাবি করেন, ব্যক্তিগতভাবে তার গাভীর খামার থাকলেও সেখানে কোনো কারারক্ষীকে দায়িত্ব দেননি। এছাড়া ঘুষ দুর্নীতির প্রতিটি অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ad

পাঠকের মতামত