কংগ্রেস নয়, আম আদমিই মোদির জন্য হুমকী
ভারতে ক্রমেই বিরোধী রাজনীতির বহুল আলোচিত ব্যক্তি হয়ে উঠছেন দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এ সময়ে দিলি্লর আম আদমি সরকারের সঙ্গে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধ তুঙ্গে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও আম আদমি পার্টির প্রবল সমালোচক। কিন্তু বিরোধী কংগ্রেসের শূন্যস্থান পূরণে কেজরিওয়ালের দলই বিজেপির মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে।
ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, আগামী বছরের গোড়ার দিকে পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি ক্ষমতা দখলের পথে। সেখানে বিজেপির শরিক আকালি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এতদিন ছিল কংগ্রেস। কিন্তু সেই কংগ্রেসকে পেছনে ফেলে এখন আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এমনকি দিলি্লতে আম আদমি সরকারের এক বছর পর জনপ্রিয়তায় কিঞ্চিৎ ভাটা পড়লেও পাঞ্জাবে কেজরিওয়াল ক্রমেই বিকল্প পার্টি হয়ে উঠছে। পাঞ্জাবে ক্ষমতা দখল করলে আম আদমি পার্টির ঝোলায় আসবে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। তাদের লক্ষ্য এখন ভারতের ছোট রাজ্যগুলোর ক্ষমতা দখল। তাই তৃতীয় লক্ষ্য গোয়া। যেখানে বিজেপি সরকারের বিকল্প হয়ে উঠতে সোনিয়া-রাহুল ব্যর্থ হয়ে উঠছেন সেখানেই তৃতীয় বিকল্প হিসেবে আম আদমি পার্টির উত্থান।
ভারতে স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতীক হয়ে উঠছেন কেজরিওয়াল। এ মুহূর্তে তিনি সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে হিমাচলের ধর্মশালায় এক আশ্রমে ‘বিপাসনা’ বা নীরব ধ্যানে নিয়োজিত করেছেন। ১০ দিন ধরে তিনি একান্তে ধ্যান করছেন। দিলি্লর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোন-ফেসবুক-টুইটার সব বন্ধ করে রেখেছেন।
তার ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, আগামী দিনে ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তিনি নিজেকে একান্তে রেখেছেন। এর আগে দিলি্ল বিধানসভা ভোটের পর তিনি একবার এ ধরনের ‘ধ্যানযোগে’ নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে।
মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দিলি্ল সরকারের দেড় বছর পূর্ণ হয়েছে। গত মার্চেই আমেরিকার ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের প্রথম ৫০ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মধ্যে ভারতের একমাত্র কেজরিওয়ালকেই স্থান দিয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও স্থান হয়নি সে তালিকায়। কেজরিওয়াল সরকারের এক বছর পূর্তি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। তারপরই দিলি্লর ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার জনমত জরিপে বলা হয়েছিল, এখনও কেজরিওয়াল জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী। আজ যদি নির্বাচন হয় তাহলে কেজরিওয়ালই আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন।
ইদানীং দিলি্লর কেজরিওয়ালের সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের লড়াই তীব্র। বিশেষ করে দিলি্লকে পূর্ণ রাজ্য দেওয়ার অধিকার নিয়ে সংঘাত আদালত পর্যন্ত পেঁৗছেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য- কোনো দেশে রাজধানীকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় না। কেজরিওয়ালের অভিযোগ, এক সময়ে বিজেপি ও কংগ্রেস দুই দলই দিলি্লকে পূর্ণ রাজ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ আম আদমি পার্টি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই প্রতিশ্রুতি পালন করছে না ভারত সরকার। বরং বিভিন্ন অফিসার নিয়োগ ও বদলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে দিলি্লর উপ-রাজ্যপাল একতরফাভাবে করছেন। দিলি্লর হাইকোর্ট অবশ্য কেজরিওয়ালের দাবি খারিজ করে দিয়েছেন। এখন তারা সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন। কিন্তু এই পূর্ণ রাজ্যের দাবিকে কেজরিওয়াল এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার করে সাধারণ মানুষের সমবেদনা আদায় করতে মরিয়া। তাদের বক্তব্য_ অধিকার পেলে মানুষের জন্য আরও কাজ করা যেত।
গত এক বছরে আম আদমি পার্টির বিধায়করা নানা অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন। ১২ জন বিধায়ক বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন দিলি্ল পুলিশের হাতে। কারও বিরুদ্ধে জাল শিক্ষা সার্টিফিকেটের অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে নারী নিগ্রহের অভিযোগ। আবার কারও বিরুদ্ধে রয়েছে অসাধু উপায়ে অর্থ তোলার অভিযোগ। যেহেতু দিলি্ল পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, তাই কেজরিওয়াল এসব অভিযোগকে কেন্দ্রের, এমনকি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের সমবেদনা কুড়াচ্ছেন। তবে এটি মানতেই হবে যে, দিলি্লর অভিজাত এলাকার এবং উচ্চবিত্তরা ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছেন আম আদমি পার্টির প্রতি। কিন্তু গরিব মানুষের সহানুভূতি এখনও আম আদমি পার্টির প্রতি অটুট।
আম আদমি পার্টির ২১ বিধায়ককে আইন ভঙ্গ করে সংসদীয় সচিব নিয়োগ করা নিয়ে অভিযোগ এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিবেচনাধীন। বিশ্লেষকদের মতে, এদের বিধায়ক পদ খারিজ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তা সত্ত্বেও কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তা অটুট। তাই তো পাঞ্জাবের সাবেক ক্রিকেটার নবজিত সিং সিধু বিজেপি সংসদ সদস্যের পদ ত্যাগ করে এখন আম আদমি পার্টির প্রচারক হবেন বলে জল্পনা। যদিও তিনি এখনও ঘোষণা করেননি।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তার কারণ কী? তিনি নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার রূপায়ণ কতটা হয়েছে? কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ দিলি্লর পরিবেশ দূষণ ও ট্রাফিক জ্যাম দূর করার জন্য জোড়-বিজোড় মোটরগাড়ি চালানোর নিয়ম প্রবর্তন। এ নিয়মের দরুন মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলেও অধিকাংশ মানুষ স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া ততটা অনুকূল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল সাময়িকভাবে নিয়মটি স্থগিত করে রেখেছেন। জানা গেছে, বিপাসনা থেকে ফেরার পর তিনি আবার এ নিয়ম চালু করতে পারেন। বস্তুত এ কারণেই তিনি পশ্চিমা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা বলে আখ্যা দেয় ফরচুন ম্যাগাজিন। এ তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন ১০ম স্থানে। কেজরিওয়ালের স্থান ৪২তম।
এক বছরের মধ্যে দিলি্লর গরিব মানুষের সমর্থন বজায় রাখার জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। কিন্তু এখনও অনেক প্রতিশ্রুতি পালন হয়নি বলে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। যে কারণে এক বছরের মধ্যে পৌরসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। বরং প্রায় মুছে যাওয়া কংগ্রেমের উত্থান হচ্ছে। সেই তুলনায় দিলি্লতে বিজেপির তেমন শক্তিবৃদ্ধি ঘটেনি। অনেকটা এ কারণেই কেজরিওয়াল দিলি্লর ভারত সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন। গরিব মানুষকে বলেছিলেন, চারশ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনা মাশুলে দেবেন। সেটা দিয়েছেন। কিন্তু তার ওপরের গ্রাহকদের মাশুল বাড়িয়ে দিয়ে অসন্তোষের শিকার হয়েছেন।
সব থেকে জনপ্রিয় প্রকল্প হলো মহল্লায় চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা এবং বিনা অর্থে ওষুধ সরবরাহ করা। প্রতি পরিবারকে মাসে ২০ কিলোলিটার পানি বিনা মূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। তবে দিলি্লর আম জনতার হাতে সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন সেটা পূরণ হয়নি। দিলি্লর পানি সমস্যা সমাধানে যমুনা নদীর পানি পরিশোধন করার প্রকল্প এখনও শুরু হয়নি। দিলি্লর নারীদের নিরাপত্তা বাড়াতে প্রত্যেক এলাকায় সিসি টিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ হয়নি। ফ্রি ওয়াইফাই দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও পালিত হয়নি।
নির্বাচনী ইশতেহারে ৭০টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এক জরিপের মতে, প্রথম বছর ২৩ শতাংশ পালিত হয়েছে। ৩৭ শতাংশের কাজ শুরু হয়েছে। এসব সত্ত্বেও দিলি্লর বাইরে কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। উত্তরপ্রদেশের মতো বৃহৎ রাজ্যে আম আদমি পার্টির কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু অন্য সব রাজ্যে যেখানে কংগ্রেসের প্রধান শক্তিরূপে উত্থানের সম্ভাবনা নেই, সেখানে আম আদমি পার্টি বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে। পাঞ্জাব রাজ্যে যদি শেষ পর্যন্ত আম আদমি পার্টি জয়ী হয় তাহলে কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কেজরিওয়াল প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন।