‘ব্যারিস্টার’ থেকে ‘জঙ্গি’!

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাত দিয়ে উগ্রবাদে জড়িত হিসেবে সবশেষ যাদের নাম এসেছে তাদের একজন ইংল্যান্ড থেকে বার এট ল পাসের পর ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করতেন বলে জানিয়েছেন তার বাবা। একই সঙ্গে তিনি ভুঁইয়া একাডেমিসহ বিভিন্ন আইন কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করতেন। গত বছর স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু সন্তান রুমাইসাকে নিয়ে সৌদি আরব নিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।

তার নাম এ কে এম তাকিউর রহমান। তার বাড়ি বগুড়ায়। তবে জীবনের একটি বড় অংশই বিদেশে কাটিয়েছেন তিনি। বাবা আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বিত্ত বৈভবের অভাব নেই। ভারতের দার্জিলিংয়ে ইংরেজি মাধ্যম থেকে গ্রেড ফোর থেকে ও লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর দেশে এ লেভেল পড়েছেন তাকিউর। এরপর ইংল্যান্ডের ক্যান্ট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাসের পর লন্ডন থেকে বার অ্যাট ল করে ২০১১ সালে দেশে ফেরেন তাকিউর।

দেশে ফেরার পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মেয়েকে বিয়ে করেন তাকিউর। এরপর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।

তাকিউরের এক স্বজন জানান, ২০১৫ সালের এপ্রিলে ওমরাহ করার কথা বলে স্ত্রীকে নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তাকিউর। সেখান থেকেই নিখোঁজ হন তিনি।

ওই স্বজন বলেন, ‘তখন তার অন্তর্ধানের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এ নিয়ে উদ্বেগ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় নিখোঁজ তরুণদের সম্পৃক্ততার প্রশ্ন আসায় বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। আর কিছুদিন আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করে। তখন আমরা বুঝতে পারি তাকিউরও হয়ত এই পথেই গেছে।

ওই স্বজন জানান, ওমরাহ শেষে দেশে ফেরার নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর ফোন নম্বরটিও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ফেসবুকে নক করে তাকে আর পাওয়া যায়নি। সেটাও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখা হয়েছে।

ব্যবসায়ী আবদুল খালেক একমাত্র ছেলেকে মানুষ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। তার ছেলে উগ্রপন্থায় চলে যাবে, এটা তিনি এখনও বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, ‘দেশে আসার পর আমি তাকে (তাকিউর) বারবার জিজ্ঞেস করেছি তুমি কোনো দল বা সংগঠনের সঙ্গে জড়াওনি তো? সে সব সময় না করেছে।’

আবদুল খালেক জানান, ২০১১ সালে দেশে ফেরার পর তার ছেলে হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হয়। পাশাপাশি বেশ কিছু কলেজে ক্লাস নিতেন। তিনি বলেন, ‘এত কাজ করে কেউ জঙ্গি হবে, সেটা কীভাবে মেনে নেই বলুন।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় বলতাম, বাবা তুমি বগুড়ায় এসে ব্যবসা দেখাশোনা করো। সে বলতো ঢাকায় এটা ওটা করে ভালো আয় হয়, ব্যবসায় আসবে না। আমিও তার কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করিনি।’

তাকিউরের বাবার দাবি অনুযায়ী হাইকোর্টে আইনজীবীদের তালিকায় তাকিউরের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘এই নামে কোনো ব্যরিস্টার থাকলে তো আমরা জানতাম। হয়ত তিনি তার বাবাকে ইচ্ছে করে ভুল বলেছেন।’

আবদুল খালেক জানান, গত বছর এপ্রিলে তার ছেলে যখন সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়ার কথা জানায় তখন তার বেয়াই (তাকিউরের শ্বশুর) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার ৫ এপ্রিল দেশে ফেরার কথা ছিল। তিনি দেশে ফিরলে সৌদি আরব যেতে বলেছিলেন তাকিউরকে। কিন্তু সে কথা না শোনে আগের দিনই চলে যায়’।

তাকিউরের বাবা বলেন, ‘ওমরাহে গিয়ে মক্কা থেকে ফোন দিয়েছিল তাকিউর। আমি জানতে চাইলাম, কার সঙ্গে গেছো। সে কিছু বললো না। এরপর ১৩ বা ১৪ তারিখে আবার ফোন করলো। তখন অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে। বলেছে ভালো আছে। ২২ তারিখ দেশে আসবে বলেও জানায়। কিন্তু সেদিন আসেনি। ভাবলাম হয়ত পরে ফিরবে। কিন্তু এরপর ফোন বন্ধ হয়ে যায়।’

‘চিন্তা করলাম কোনো দুর্ঘটনা হলো কি না। ঢাকায় গেলাম। কলাবাগান থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে চাইলাম। তারা নিল না। বলে আপনার বেয়াইকে নিয়ে আসেন। তবে আরও কিছুদিন পর তাকে নিয়ে গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করলাম। এরপর পুলিশ আমাকে কিছু জানায়নি’-বলেন তাকিউরের বাবা।

আবদুল খালেক বলেন, ‘নিখোঁজের বিষয়ে তখন তো তোলপাড় হয়নি এখানের মতো। এখন তো সবাই বলাবলি করছে অন্য কিছু হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সে কোথায়, কীভাবে গেছে, আমার তো মাথায় ঢুকে না। এত ব্যস্ত ছিল সে। কারও খপ্পরে পড়েছে হয়ত। তার সঙ্গে নিশ্চিত প্রতারণা করা হয়েছে।’

গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী এবং তাদের বাবা-মার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এদের কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। এবং একজন সিরিয়ায় আইএসবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

নিখোঁজদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে টেলিভিশনগুলোতে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। আর গত কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকজনকে ধরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এতে বলা হচ্ছে, এরা ঢাকার আশেপাশে অবস্থান করে নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ad

পাঠকের মতামত