হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পেরে জঙ্গি নেতা হলেন মেজর জিয়া

Major Ziaএক সময় সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। তড়তড় করে ওপরে ওঠার সুযোগও ছিল তার। কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে তার। তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষ তিনি। কিন্তু সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টায় পা বাড়ান তিনি। এরপর ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি পান সবার কাছে।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের অভ্যুত্থান চেষ্টার ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে। ২০১১ সালে ঘটে এই ঘটনা। এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছে তিনি। আত্মগোপনে থেকেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান জিয়া, দায়িত্ব নেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামারিক শাখার। তার পরিকল্পনায় একাধিক ব্লগার, লেখক, ভিন্ন মতালম্বী ও ধর্মালম্বী খুন হন।

পলাতক এই ব্যক্তির নাম মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার এই ঘোষণা দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।

আইজিপি বলেন, আমরা বিভিন্ন মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একজন শীর্ষ নেতার সন্ধান পেয়েছি। তিনি সেনাবাহিনীর এক বহিষ্কৃত মেজর। তার নাম সৈয়দ জিয়াউল হক। তাকে ধরতে আমাদের গোয়েন্দারা অনেকদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন।

এদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি বলছে, সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ জিয়া। ২০১১ সালে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে অভ্যূত্থানের চেষ্টা করেন তিনি। ওই বছর ১১ ডিসেম্বর এই ব্যর্থ অভ্যূত্থানের চেষ্টা করা হয়। ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তারা তার অভ্যূত্থান চেষ্টা ভেস্তে দেন।

এরপর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সেনাসদর থেকে এই ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সে সময় জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে শিগগিরই ঢাকার লগ এরিয়া সদর দপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলেও তিনি পলাতক থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ঘটনার পর থেকেই সৈয়দ জিয়াউল হক পলাতক রয়েছেন। তাকে ধরার জন্য বিভিন্ন সময়ে অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু আত্মগোপনে থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ধীরে ধীরে জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। সামরিক শাখার দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কিলিং মিশন শুরু করে। গত বছর ঢাকার একাধিক ব্লগার ও লেখক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জিয়ার সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারেন।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরেই সবচেয়ে বেশি ব্লগার হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা এত বেশি নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, ঘাতকদের শনাক্ত ও গ্রেফতার কঠিন হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিয়াউল হক ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন চৌকস অফিসার। কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে তার। তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষ তিনি। এ কারণে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তরুণদের তিনি নিখুঁতভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। কিলিং মিশনের পরিকল্পনাও করে দিতেন তিনি। কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়, তা তার ভালোভাবেই জানা। এ কারণে গত বছরের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ঘটানো অনেক হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে বেগ পেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটি)সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ জুন ব্লগার ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যা চেষ্টার মামলায় সুমন হোসেন পাটোয়ারী নামে এক আনসারুল্লাহ সদস্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে সুমন বলেন, ‘উত্তরায় আমাদের আস্তানায় এক ‘বড়ভাই’ নিয়মিত আসতেন। ওই ‘বড়ভাই’ আমাদের সবার নেতা। ‘বড়ভাই’ আমাদের বলতেন, ‘আল্লাহর জন্য কাজ করতে হবে এবং নাস্তিকদের কতল করতে হবে’। তিনি আমাদের জানান, তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন এবং জিহাদের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাদের নেতা বড়ভাইয়ের নাম ইশতিয়াক বলে শুনেছি।’

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, এই ইশতিয়াকই আসলে মেজর জিয়া। ইশতিয়াক তার সাংগঠনিক নাম। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকার সময় বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করেন।

জিয়া সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মেজর জিয়া এক সময় বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার ৯ নম্বর সড়কের ৫১২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন। তার বাবার নাম সৈয়দ জিল্লুর হক। তার সর্বশেষ ঠিকানা পলাশ, ১২তলা, মিরপুর সেনানিবাস উল্লেখ ছিল। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। তার পাসপোর্ট নম্বর এক্স ০৬১৪৯২৩।

ব্যর্থ অভ্যূত্থান চেষ্টার পর পরই তিনি বারিধারার বাসা থেকে পালিয়ে যান। এরপর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও ভাটারা এলাকায় আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটি)একজন কর্মকর্তা জানান, ভাটারার এক বাসায় অভিযান চালিয়ে তারা জিয়াকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন। অভিযানের কয়েক মিনিট আগে টের পেয়ে তিনি ওই আস্তানা থেকে পালিয়ে যান।

সিটির ওই কর্মকর্তা বলেন, জিয়া হলো ভয়ানক চতুর ও দুর্ধর্ষ। নিজেকে আড়ালে রাখার সব কৌশল রপ্ত তার। তাকে ধরতে ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি চলছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জিয়া দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন বলে তথ্য রয়েছে।একটি মামলার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জিয়ার সাংগঠনিক নাম এসেছে। তাকে আমরা অনেক আগে থেকেই গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।

ad

পাঠকের মতামত