‘ইশরাত, তুমি কি বুঝতে পারছো, অনুভব করছো!’
ঢাকার গুলশানে গত শুক্রবার হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় বিপথগামী কয়েকজন তরুণের হাতে নির্মমভাবে মারা যান ২০ জন, ইশরাত আখন্দ তাঁদেরই একজন। তিনি বাংলাদেশের একটি আর্ট গ্যালারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যুক্ত ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে। একটি গানের মিউজিক ভিডিওর মডেলও হয়েছিলেন তিনি। গানের শিরোনাম ‘প্রবঞ্চনা’। গানটিতে কণ্ঠ, সুর ও সংগীয়োজন করেছিলেন সংগীতশিল্পী শান্তনু বিশ্বাস। মিউজিক ভিডিওটির নির্দেশনা দিয়েছেন ইফতেখারউদ্দিন বান্টি।
ইশরাত আখন্দের নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর মর্মাহত হন শান্তনু বিশ্বাস। ফেসবুকে ইশরাত আখন্দকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে একটি পোস্ট করেন তিনি। সেই পোস্টে শান্তনু বিশ্বাস উল্লেখ করেন তাঁকে লেখা ইশরাতের একটি খুদেবার্তার কথা। শান্তনুকে উদ্দেশ করে লেখা ইশরাতের সেই বার্তায় ছিল :
‘আপনার সাদাকালো বহুবার শুনেছি এবং দেখেছি। তার পর থেকে আপনি আমার প্রিয় songwriter-singer-দের একজন। আমি লেনার্ড কোহেনের বিপুল ভক্ত। তাঁর গান আমাকে উজ্জীবিত করে। কারণ তাঁর গান সব সময় নতুন মনে হয়। আপনার গানে সেই এলিমেন্ট আছে। personal dream আর collective reality-এর clash আছে আপনার গানে। It’s very modern… please accept my friend request, you can call me at ………..।’
এই বার্তাটি পাওয়ার পরই শান্তনু বিশ্বাস ইশরাত আখন্দকে ফেসবুক ফ্রেন্ড করে নেন। এরপর তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। একটি অনুষ্ঠানে শান্তনুকে প্রথম দেখার পর নিজের বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইশরাত।
ইশরাত আখন্দের বাসায় যাওয়ার পর শান্তনু বিশ্বাস তাঁর অনুভূতির কথা ফেসবুকে এভাবে লিখেছিলেন- ‘কি পরিপাটি করে সাজানো ফ্ল্যাট। দেয়ালে দেয়ালে তৈলচিত্র, জলরঙ ছবি। জানলাম খুব ভালো সংগ্রহ রয়েছে তাঁর। ফেসবুক থেকে এক লহমায় সে হয়ে গেল আমার বিশেষ বন্ধুদের একজন। তার অবিরাম কথা আমার গান নিয়ে, তার শিল্প জিজ্ঞাসা, ইচ্ছে, ছবির কথা, শিল্পীদের নিয়ে ভাবনা, শুনছিলাম, আর চোখের সামনে পাপড়ির মতো খুলছিল আবেগে টগবগে একজন ভালো মানুষের ছবি।’
ইশরাত আখন্দের একটি স্টুডিও ছিল গুলশানে। যেখানে তিনি আয়োজন করতেন তরুণ শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। আবৃত্তি মেলা ও মুক্ত আলোচনাও হতো সেখানে। নিজের টাকা খরচ করে দেশের বাইরে তরুণ চিত্রশিল্পীদের ছবিও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন তিনি।
এ ছাড়া চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার প্রতিও ইশরাত আখন্দের আগ্রহ ছিল। তিনি নাকি শান্তনু বিশ্বাসকে এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘শান্তনুদা, আমার ভাবনার একটা সিনোপসিস দেব, আপনি সে অনুযায়ী চিত্রনাট্য তৈরি করবেন।’
প্রিয় বন্ধুর নির্মমভাবে খুন হওয়ার ঘটনা একদম মেনে নিতে পারছেন না শান্তনু। তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘মৃত্যু অনিবার্য, সে তো আমরা জানি। কিন্তু এমন আকস্মিক ওকে হারাব, এ তো দুঃস্বপ্নেও ছিল না। আর এমন নির্দয় হত্যা। আহা, কেন সে কি প্রতিবাদ করেছিল সেই ছোকরাদের মুখের ওপর কেন আমাকে প্রমাণ দিতে হবে আমি কোন ধর্মের, বা কেন সে হিজাব পরেনি। যদি সে বিদেশি বন্ধু নিয়ে যায়, সে বন্ধুর দায় তো তারও। জীবন তো জীবনই, ধর্ম দিয়ে কি জীবনকে আলাদা করা যায়। সেই কথা হয়তো বলতে গিয়েছিল এবং তাই নির্মমভাবে রক্তাক্ত হতে হতে নিথর হয়ে গিয়েছিল মুখর মুখরিত বন্ধু আমার ইশরাত। আমার গান বাঁচবে কি না তা নিয়ে বিশ্বাস করো ইশরাত আমি একটিবারও ভাবিনি, তোমাদের এই ভালোলাগাটুকু দিয়ে আমার গানকে শত শতবার ভরিয়ে তুলেছি, সেখানে আমার কী বিপুল আনন্দ, কী অপরিমেয় তৃপ্তি, কী করে তোমাকে বোঝাই ইশরাত। তোমাকে হারিয়ে ফেলার অগাধ কষ্ট আমার গলা পর্যন্ত উঠে আসছে, আমি কিছুতেই কিছু করতে পারছি না, তুমি কি বুঝতে পারছো, অনুভব করছো ইশরাত….।’
নিচে সেই মিউজিক ভিডিওটি-
https://youtu.be/LMVw7S3g0rU