343813

যেসব রাজ্য নির্ধারণ করবে কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি অন্য দেশের তুলনায় ভিন্ন এবং কিছুটা জটিল। কোনো একজন প্রার্থী নাগরিকদের সরাসরি ভোট পেলেই যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন তা কিন্তু নয়। বরং ইলেকটোরাল কলেজ নামে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশেষ নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে— তার মাধ্যমেই ঠিক হয় কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।

এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি লিখেছে, আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থীরা সাধারণ ভোটারদের যে ভোটগুলো পাবেন, সেটাকে আদতে বলা হয় পপুলার ভোট। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটকে বলা হয় ইলেকটোরাল ভোট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট আছে।

দুটি ছাড়া দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যের নিয়ম হলো— যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাবেন, তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যাবেন। এভাবে সবগুলো রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট যোগ হয়ে যে প্রার্থী মোট ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পাবেন— তিনিই নির্বাচিত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

নির্বাচনী রণক্ষেত্র বা ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট-প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এই ইলেকটোরাল কলেজ? এরা হচ্ছেন, একদল নির্বাচকমণ্ডলী বা কর্মকর্তা, যারা একেকটি রাজ্যের পপুলার ভোটে প্রতিফলিত রায় অনুযায়ী ভোট দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ এই নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশটির সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত এবং রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় আইনের অধীনে একটি জটিল ব্যবস্থাই বলা যায় একে।

মোট ইলেকটোরাল কলেজে ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। তাই হোয়াইট হাউসের দৌড়ে বিজয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে এর মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হবে। ফলে প্রার্থীদের কাছে কিছু কিছু অঙ্গরাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেগুলোকে বলা হয় ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র’।

ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সে সব রাজ্যে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যাও বেশি। যে রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি সেখানে ইলেকটোরাল ভোটও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই সর্বাধিক ইলেকটোরাল ভোট জেতার জন্য বিশেষ কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়।

কেন এক একটি অঙ্গরাজ্য ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ হয়ে ওঠে?-যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে, বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের অনুকূলে ভোট দিয়ে থাকে। আর এই কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা কিছুটা এমনকি অনেকটাই নিশ্চিত থাকেন যে, তারা প্রথাগতভাবে এসব রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটগুলো পাবেন।

মার্কিন নির্বাচনে প্রধান দুই দলের মধ্যে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’। কিন্তু হাতে গোণা কিছু অঙ্গরাজ্য আছে, যে রাজ্যগুলোর ভোট, প্রার্থীদের কারণে যে কোনো শিবিরে যেতে পারে।

এ গুলোই হল যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ব্যাটলগ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র। এসব রাজ্যকে অনেকে বলে থাকে ‘বেগুনি রাজ্য। আর এসব অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে জয় পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। ফলে এই রাজ্যগুলোতেই হয় নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

এসব রাজ্যেই প্রচারণায় সময় ও অর্থ দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি এবং ঘন ঘন চলে প্রার্থীদের আনাগোণা, প্রচারণা সমাবেশ। এই যেমন করোনা থেকে সেরে উঠতে না উঠতেই তৃতীয় সর্বোচ্চ ইলেকটোরাল ভোট থাকা ফ্লোরিডায় ছুটে যান রিপাবলিকান দলীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে ডেমোক্র্যাট বাইডেনেও ব্যাপক প্রচার চালান সেখানে।

এবারের নির্বাচনে ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য কোনগুলো-মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে এসব রাজ্যে অনেক ভোটারই কোনো দলের কট্টর সমর্থক নন এবং প্রার্থীদের নীতিমালা এবং আগামী চার বছরের জন্য প্রার্থীদের পরিকল্পনার বিচারে তারা শেষ মুহূর্তে ভোট দেন।

তারা প্রচার প্রচারণার নিরিখে কাকে ভোট দেবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। ফলে এই রাজ্যগুলোর ভোটই চূড়ান্ত ফলকে যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে ঠেলে দিতে পারে।

এই ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটগুলোতে ভোট কোন্ দুর্গে যাবে তা যেহেতু বোঝা কঠিন তাই এই রাজ্যগুলোকে সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্যও বলা হয়।

সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য-নির্বাচনী সময়সূচির মধ্যে যে কোন সময়ে এই ব্যাটলগ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্রে ভোটের অঙ্ক বদলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে প্রার্থীদের বা ওই দলের যে কোনো বিষয়।

ফাইভ থার্টি এইট নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্বাচন বিষয়ক ওয়েবাসইট, যারা মার্কিন নির্বাচনের আগে দেশটির ভোটারদের জনমত জরিপ বিশ্লেষণ করে। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিছু অঙ্গরাজ্যকে গত কয়েকটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বরাবরই ‘সুইং স্টেট’ হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে।

বিগত কয়েকটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে অঙ্গরাজ্যগুলোর দোদুল্যমান ভোট প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জয়-পরাজয় নিশ্চিত করেছে সেগুলোর মধ্যে ছিল কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইসকনসিন।

২০০৪-২০১৬; চারটি নির্বাচনে জুন পর্যন্ত জনমত জরিপের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, ২০২০ এর নির্বাচনে অ্যারিজোনা, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা আর উইসকনসিন গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেট হয়ে উঠতে পারে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক ২০২০ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান স্টেটের তালিকায় রাখছেন অ্যারিজোনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যকে। কারও মতে এবার নর্থ ক্যারোলাইনা, ফ্লোরিডা, মিশিগান, উনসকনসিন এবং অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যগুলো নির্ধারক সুইং স্টেট হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কারণ এই অঙ্গরাজ্যগুলো থেকেই ২০১৬ সালের নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে অল্প ব্যবধানে ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিন্টনের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাজেই ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের জন্য এই রাজ্যগুলোর ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ধরে রাখা খুবই জরুরি হবে।

তবে জনমত জরিপ যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে এখন পর্যন্ত জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-নির্ধারক অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রতিযোগিতার দৌড়ে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন এখনও একটা সুবিধাজনক অবস্থানেই রয়েছেন। তবে এই পরিস্থিতি যে কোন সময় বদলে যেতে পারে।

ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যে কে এগিয়ে-বর্তমান জরিপের ফলাফল বাইডেনের পক্ষে হলেও নির্বাচনের এখনও দুই সপ্তাহ বাকি। অতীত রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, নির্বাচনী রণক্ষেত্রে জনমত জরিপ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোন সময় যে কোন দিকে যেতে পারে।

গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত বিবিসি সংকলিত জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাইডেন মিশিগান, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন রাজ্যে এগিয়ে আছেন। এসব রাজ্যে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ শতাংশের এরও কম ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন।

এখনকার জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব রাজ্যে এগিয়ে আছেন সেগুলো হচ্ছে; জর্জিয়া, আইওয়া এবং টেক্সাস। কিন্তু এখানেও ব্যবধান খুব সামান্য। গত নির্বাচনেও এসব রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের ব্যবধান ছিল আরও অনেক বেশি। ফলে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা বলা মুশকিল।

বাইডেন অন্য যেসব রাজ্যে এ পর্যন্ত এগিয়ে আছেন, সেগুলো হল; অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, মিশিগান, মিনেসোটা, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসালভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইসকনসিন।

বাইডেনের জন্যে ভালো খবর এসব রাজ্যে তিনি বড় ব্যবধানে এগিয়ে। এ ছাড়া গত নির্বাচনে এসব রাজ্যের অধিকাংশগুলোতেই ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এসব রাজ্যে এখন এগিয়ে গেছেন জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এখন এটাই দুশ্চিন্তার কারণ। তবে প্রচার প্রচারণা এখনও অনেক বাকি।

ইলেকটোরাল কলেজের ভোট-ইলেকটোরাল কলেজ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ইলেকটরস বলা হয়। এক কথায় নির্বাচকমণ্ডলী। চার বছর পর পর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বাছাই করেন।

কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে ইলেকটরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। যা নির্ধারিত হয় রাজ্যে সিনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক রাজ্যে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে।

ইলেকটোরাল কলেজের ভিত্তিতে সবচেয়ে বড় ছয়টি অঙ্গরাজ্য হলো ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), টেক্সাস (৩৮), নিউইয়র্ক (২৯), ফ্লোরিডা (২৯), ইলিনয় (২০) এবং পেনসিলভেনিয়া (২০)। প্রতিটি নির্বাচনের দেখা গেছে যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পেছনে অনেক বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। ফলে এই ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে জয়ের জন্য আগামীতে দুই দলের প্রার্থীরা যে মরিয়া হয়ে প্রচার চালাবেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের এবার ইতোমধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ আমেরিকান আগাম তাদের ভোট দিয়ে ফেলেছেন।

ad

পাঠকের মতামত