343504

মমতার সাম্রাজ্যে বড় বিপদ!

আর মাস ছয়েকের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। পুজোর বাদ্যি থামার আগেই ভোটের বাদ্যি বেজে যাবে গঙ্গা পাড়ে। দিন যত গড়াচ্ছে, রাজনৈতিক সং’ঘর্ষও তত তীব্র হচ্ছে। নির্বাচনে রাজনৈতিক বিতর্ক হবেই। সেটাই কাম্য। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, তার দায় রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিতে হবে। শাসক দল তৃণমূলের যতটা দায়, তার চেয়ে এতটুকু কম দায় নয় বিরোধী বিজেপির।

২০১৬ সালেও পশ্চিমবঙ্গে কার্যত কোনো জায়গা ছিল না বিজেপির। ১০ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রদীপের আলোর মতোই টিটিমে অস্তিত্ব ছিল দলটির। অথচ সেই বিজেপিই ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে বঙ্গভূমিতে। কেন পেয়েছে? এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাম এবং কংগ্রেসকে সাইনবোর্ড বানাতে গিয়ে শাসক দল তৃণমূল যে বিজেপিকে খাল কেটে নিয়ে এসেছে, তা এখন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন। কিন্তু এটাই কেবল একমাত্র কারণ নয়। খুব সন্তর্পণে পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে বিভেদের রাজনীতির বিজ রোপণ করে দিতে পেরেছে বিজেপি। কী ভাবে?

২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের প্রায় সবক’টি জনসভা সাংবাদিক হিসেবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা কী ভাবে সাম্প্রদায়িক সুর চড়িয়েছিলেন, তা বিলক্ষণ মনে আছে। প্রায় প্রতিটি সভায় এনারসি আর সিএএ-এর প্রসঙ্গ টেনে এনে মুসলিম বিদ্বেষ প্রকট করার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশ সীমান্তের পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য খড়ের গাদায় জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলার মতো। এবং সেটাই ঘটেছিল। বড় আকারে না হলেও দিকে দিকে ছোট ছোট সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা একাধিক ঘটেছে। এবং এখনও ঘটছে। শুধু তাই নয়, গেরুয়া বাহিনীর আইটি সেল লাগাতার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্বেষমূলক পোস্ট করে গিয়েছে।

গেরুয়া বাহিনী শব্দটি একটু ব্যাখ্যা করে দেয়া ভালো। আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অনেকগুলো সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন আছে। বিজেপি যেমন তাদের রাজনৈতিক সংগঠন তেমনই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল তাদের সামাজিক সংগঠন। একত্রে এই সমস্ত সংগঠনকে গেরুয়া বাহিনী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রতিটি সংগঠনেরই নিজস্ব আইটি সেল রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা অত্যন্ত অ্যাক্টিভ। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে দক্ষিণবঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তের বসিরহাট দেগঙ্গায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে একবার দিল্লির দিকে তাকানো যাক। মাস কয়েক আগে দিল্লিতে নির্বাচন হয়েছে। বহরে দিল্লির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোনো তুলনাই চলে না। দিল্লি ছোট একটি জায়গা। এখানকার নির্বাচনের বিস্তারও কম। পশ্চিমবঙ্গ একটি বড় রাজ্য। সেখানে রাজনীতির বিস্তার অনেক বেশি। কিন্তু সাধারণ দিল্লি নির্বাচনেও সিএএ এবং এনআরসিকে সামনে রেখে, প্রতিবাদীদের সামনে রেখে বিজেপি কী ধরনের প্রচার চালিয়েছিল, তা এখনো অনেকের মনেই টাটকা। শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তীব্র ভাষায় আক্রমণ চালিয়েছিলেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ‘গোলি মারো শালো কো’ স্লোগান এখনও ইতিহাস হয়ে যায়নি। বিজেপি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল, দিল্লিতে বিভেদের আবহ তৈরি করতে। দিল্লি দাঙ্গার রেশ এখনো কাটেনি।

দিল্লির প্রচারের কায়দায় যদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি প্রচার শুরু করে, তা হলে কী ঘটতে পারে, তার আঁচ এর আগেই পাওয়া গিয়েছে। মনে রাখা দরকার, পশ্চিমঙ্গে সংখ্যালঘু ভোট ৩৩ শতাংশ। মুসলিম ভোট ২৮ দশমিক ছয় শতাংশ। সেখানে সামান্য আগুন মারাত্মক হতে পারে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মেরুকরণের সেই ভয়াবহতা পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। ২০২১ সালেও যদি সেই রাজনীতি চলতে থাকে, তা হলে মেরুকরণ আরও ভয়াবহ চেহারা নেবে।

নিচ্ছে। ঠিক সেটাই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। খু’নোখু’নি শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশেষ বিশেষ এলাকা থেকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর মিলছে। সব চেয়ে বড় কথা, গোটা রাজ্য জুড়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।

এক সময় ঠিক এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিশেষ কিছু করে উঠতে পারতো না। বলা হতো, হিন্দি বলয়ের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে চলে না। দীর্ঘ বাম এবং কংগ্রেস ঐতিহ্যই পশ্চিমবঙ্গকে বিভেদের রাজনীতি থেকে খানিক আড়াল করে রেখেছিল। তৃণমূল সেই আড়াল তুলে দিয়েছে। বিজেপিও তার সম্পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে। শুধু একটি কথাই এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। বিজেপি যে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে, তা একবার লেগে গেলে বিজেপিও কিন্তু তা সামলাতে পারবে না। জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে সব। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা সে কথা মনে রেখেছেন কি?

পুনশ্চ : পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির একটি অংশ দলভাঙা তৃণমূল। একসময় বিজেপি যাদের গালিগালাজ করতো, এখন তাঁরাই বিজেপির বড় বড় নেতা। বিভেদের রাজনীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তাঁরা কিন্তু জানেন। আকাশে মেঘ দেখলে মাঝি নৌকো ডাঙায় তোলেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আসমানে সেই মেঘ স্পষ্ট।

রাজনীতির কাণ্ডারীরা একটু সাবধান হলেই ভালো।

সূত্র : ডয়চে ভেলে

ad

পাঠকের মতামত