343508

পাক-ভারত যু’দ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল ‘মুসলিম’ রেজিমেন্ট!

১৯৬৫ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ‘মুসলিম রেজিমেন্ট’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যু’দ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো বলে একটি খবর ভারতের সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ চাউর হয়েছে। ভাইরাল হওয়া এই ‘বার্তা’ তুলে ধরে বেশ কিছু মানুষ আইএএস ও আইপিএস অফিসার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিম প্রার্থীদের ‘আনুগত্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। টুইটারে @FansYati আইডি থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর বার্তাটি শেয়ার করা হয়। তার টুইটে ২,৪০০ লাইক পড়ে এবং এই লেখা পর্যন্ত তা ৯৯৮ বার রিটুইট হয়েছে।

এই দাবি টুইটার ও ফেসবুক দুই জায়গাতেই ভাইরাল হয়েছে এবং বার্তাটি ভিডিও আকারে ছড়ানো হয়েছে। বিজেপি’র ন্যাশনাল মিডিয়া পেনেলিস্ট যশবীর রাঘবের ২০১৭ সালের একটি টুইটও এতে স্থান পায়। এই সংবাদ মাধ্যম তদন্ত করে দেখেছে, ২০১৭ সাল থেকেই এই দাবি অনলাইনে ঘুরছে।

ব্যাপকভাবে কি-ওয়ার্স সার্চ করে আমরা ২০২০ সালের ২২ জুলাই এবিপি নিউজের একটি রিপোর্ট থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবগুলো রেজিমেন্টের একটি তালিকা পাই। তালিকায় কোন মুসলিম রেজিমেন্টের নাম পাওয়া যায়নি। এছাড়া আমরা ২০২০ সালের ১৫ জুলাই জাগরণ জোশ-এর একটি লেখা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্ণভিত্তিক রেজিমেন্টের তালিকা যাচাই করি। সেখানেও কোন মুসলিম রেজিমেন্টের উল্লেখ নেই।

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কোনকালেই কোন মুসলিম রেজিমেন্ট ছিলো না। ওই নিবন্ধ লিখেছিলেন লে. জেনারেল (অব:) সৈয়দ আতা হোসেন।

এই ভাইরাল হওয়া দাবি নিয়ে সম্প্রতি বিবিসি নিউজ হিন্দি একটি তথ্য-যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে মেজর জেনারেল (অব:) শশী আসতানা বলেন : ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কখনোই মুসলিম রেজিমেন্ট বলতে কিছু ছিলো না। ব্রিটিশ আমলে বর্ণ ও সম্প্রদায়ভিত্তিতে এ ধরনের রেজিমেন্ট থাকতে পারে অথবা প্রিন্সলি আর্মি হিসেবে কাজ করা কোন বাহিনীকে এ ধরনের সম্বোধন করা হতে পারে, যেমন জম্মু-কাশ্মীর লাইট ইনফেনট্রি রেজিমেন্ট। এই রেজিমেন্ট ছিলো রাজা-শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের সেনাবাহিনী।

প্রতিবেদনে লে. জেনারেল (অব:) সৈয়দ আতা হোসেনের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন : এটা একটা প্রপাগান্ডা এবং গত ২০০ বছরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলিম রেজিমেন্ট বলতে কিছু ছিলো না। ব্রিটিশ আর্মিতে শিখ, পাঞ্জাব ও ঘারওয়াল রেজিমেন্ট ছিলো। বালুচ ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টও ছিলো। দেশ ভাগের পর বালুচ ও ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট পাকিস্তানে চলে যায় এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই বহাল থাকে।

ভাইরাল হওয়া বার্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যু’দ্ধ নিয়ে যে বক্তব্য এসেছে তা নিয়েও বিবিসি’র প্রতিবেদনে আলেচনা করা হয়। তাতে বলা হয় : ১৯৬৫ সালের যু’দ্ধ নিয়ে ভাইরাল বার্তায় যে দাবি করা হয় তা ডাহা মিথ্যা। বরং ওই যু’দ্ধে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল আব্দুল হামিদ চারটির বেশি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছিলেন। যে কারণে তাকে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান পরমবীর চক্র (মরণোত্তর) পদকে ভূষিত করা হয়।

ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কখনো কোন মুসলিম রেজিমেন্ট ছিলো না। বর্ণভিত্তিক রেজিমেন্টের নাম অনেক আগে থেকেই ছিলো এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই নামগুলো পরিবর্তন করা হয়নি। তবে এর মানে এই নয় যে, জাট রেজিমেন্টে শুধু জাটদের নিয়োগ দেয়া হয় বা রাজপুত রেজিমেন্টে রাজপুতদের নিয়োগ দেয়া হয়। সব বর্ণ ও ধর্মের লোকজন এসব রেজিমেন্টে রয়েছেন। সেনাদের ধর্ম ও বর্ণ নিয়ে রেজিমেন্টের কিছু করার নেই।

এ ব্যাপারে এই সংবাদ মাধ্যম মেজর নবদীপের সঙ্গেও কথা বলেছে। তিনিও বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলিম রেজিমেন্ট বলতে কোনোকালে কিছু ছিলো না। সেনাবাহিনী রাজনীতি নিরপেক্ষ, সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান। এখানে সব সেনা একটি জাতীয় পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করে ও লড়াই করে।

বার্তার প্রথম অংশে মুসলিম রেজিমেন্ট নিয়ে মিথ্যা কথা বলা হয়। দ্বিতীয় অংশে বলা হয় সেনা এবং আইএএস/আইপিএস পদ থেকে মুসলমানদের সরিয়ে ফেলতে। সম্প্রতি কট্টর ডানপন্থী মিডিয়া আউটলেট সুদর্শন নিউজ টেলিভিশনে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। তাতে দেখানো হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন কীভাবে বিপুল সংখ্যায় ভারত সরকারের পদগুলো দখল করছে এবং ‘ইউপিএসসি জিহাদ’ পরিচালনা করছে। এর প্রথম পর্ব প্রচারের পর এই সংবাদ মাধ্যম একটি তথ্য-যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, সুদর্শন নিউজে বিভ্রান্তিকর বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং তা ভুল তথ্য, মিথ্যা দাবি ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্যে ভর্তি।

চতুর্থ পর্ব প্রকাশের পর সুপিম কোর্ট ওই সিরিজ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি এখনো শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন।

সূত্র : এএলটি নিউজ

ad

পাঠকের মতামত