341132

বিআইডব্লিউটিসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিদিন চা খরচ চল্লিশ হাজার টাকা

রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার সংযোগস্থল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। সম্প্রতি শিমুলিয়া কাঠালবাড়ি নৌপথটি বন্ধ থাকায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে অতিমাত্রায়। এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটের পাটুরিয়া ঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি)’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নানা সমস্যায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তি লেগেই থাকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে। যেন অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এই নৌ-রুট। থেমে নেই চাঁদাবাজি। প্রকাশ্যেই বেপরোয়াভাবে চলছে টিকিট বাণিজ্য। অতিরিক্ত টাকায় টিকিট লেনদেনের বিষয়টি এখন সবার জানা।

ট্রাক চালকদের অভিযোগ, গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় এই সুযোগ ব্যবহার করে বিআইডব্লিউটিসির অসৎ কর্মকর্তারা ট্রাক চালকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করছে। সিরিয়াল অনুযায়ী টিকিট না দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা। জরুরি পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী গাড়িগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করার ফলে প্রতিদিনই এই ঘাটে আটকা পড়ছে শত শত ট্রাক। ফেরির টিকিটের জন্য তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি টাকা।

তারা আরো জানান, বড় ট্রাকের ফেরি টিকিটের মূল্য ১৪৬০ টাকা, মাঝারি ট্রাকের ১০৬০ টাকা এবং ছোট ট্রাকের টিকিটের দাম ৭৪০ টাকা। টাকা দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয় কাউন্টারে। এসময় আরও গাড়ি এসে ভিড় করে টার্মিনালে কৃত্রিম যানজট তৈরি করে সিরিয়াল আগে পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অবৈধভাবে গাড়িচালকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্তি টাকা। ট্রাকের আকার ভেদে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। এই টাকা না দিলে টিকিট পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন ঘাটে আটকে থাকতে হয় ট্রাক চালকদের।
কয়েকজন ট্রাকচালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাটুরিয়া ঘাটের মত দুর্নীতি আর ভোগান্তি দেশের কোন ঘাটে নেই। পাটুরিয়া ঘাট পার হতে গেলে অতিরিক্ত দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করতে হয়। অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে না পারলে কখনো দুই দিন আবার কখনো তিন দিন ঘাটে আটকে থাকতে হয়। তাই এই ভোগান্তির হাত থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই বেশি টাকা খরচ করেন তারা।

গত মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সরজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট দিয়ে প্রতিদিন ২২শ’ থেকে ২৫শ’ গাড়ি নদী পার হয়। এসব গাড়ির অর্ধেকই পণ্যবাহী ট্রাক। ফেরি পারাপারে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রশিদে উল্লেখিত টাকার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা না দিলে দেওয়া হয় না ফেরির টিকিট। প্রকারভেদে এসব গাড়ির টিকিটের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ টাকা প্রতিনিয়তই বাড়তি নেওয়া হয় যা দিন শেষে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ঘাটের যানজটের অবস্থা বুঝে কখনো কখনো গাড়ি প্রতি টাকার অঙ্ক ৫০০ থেকে ২ হাজার পর্যন্তও হয়।

গত মঙ্গলবার দুপুরে বিআইডাব্লিউটিসির টিকিট কাউন্টারের সামনে গেলে দেখা যায়, কাউন্টারের সামনে ট্রাক চালকদের ভীড়। সিরিয়াল না মেনে বেশি টাকা নিয়ে পরে আসা গাড়িকে আগে টিকিট দেওয়া হচ্ছে। কাউন্টারের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত সবাই এই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সাথে জড়িত। গত বুধবার সন্ধ্যার পর টিকিট কাউন্টারের সামনে যেতেই দেখা যায় জাহাজ সহকারি হারুন-অর-রশিদ টিকিটের মূল্যের চাইতে ১০০ টাকা বেশি না দিলে চালক ও হেলপারদের টিকিট দিচ্ছে না।

জাহাজ সহকারী হারুন-অর-রশিদ এই অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, চালকরা খুশি হয়ে চা খাওয়ার জন্য আমাদের কিছু বাড়তি টাকা দেয়। আমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নাই। তবে ড্রাইভারদের অভিযোগ, কাউন্টারের ভিতরে কোন টাকা গেলে সেটা আর ফেরত আসে না

অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে টার্মিনাল সুপারিটেন্ডেন্ট মাজহারুল ইসলাম, মোঃ ইজ্জত আলী ও রবিউল ইসলাম তাহেরীর সাথে কথা বলতে গেলে তারা প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে বিষয়টি স্বীকার করেন। টার্মিনাল সুপারিটেন্ডেন্ট ইজ্জত আলী বলেন, আমাদের চা পান খাওয়ার জন্য যদি কোন চালক বা হেলপার কিছু দেয় আমরা না করি না। আমরা সারাদিন কষ্ট করি তাই ড্রাইভাররা খুশি হয়েই আমাদের চা খাওয়ার জন্য কিছু দেয়। মাঝে মধ্যে ভাংতি না থাকলে তারা বাড়তি টাকা ফেরত নেয় না। মাজহারুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম তাহেরীও অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সহজ স্বীকারোক্তি দেন। অবৈধভাবে আদায়কৃত এসব অতিরিক্ত টাকা দিন শেষে কি করেন জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা সারাদিনে সামান্য কিছু টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে আমরা চা-নাস্তা খাই।

এ বিষয়ে বিআইডাব্লিউটিসির আরিচা শাখার ডিজিএম জিল্লুর রহমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি সাফাই গেয়ে বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টের বিষয়টি দৃশ্যমান, তাই সবার চোখে পড়ে। অনেক জায়গায় কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে দেখার কেউ নেই। তিনি আরো বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিন-রাত ২৪ ঘন্ট কষ্ট করে আমরা ওভারটাইম দিতে পারিনা তাই তারা হয়তো কিছু কিছু টাকা নিতে পারে। তবে কারো বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেই।

 

ad

পাঠকের মতামত