334616

বিত্তশালী বন্ধুদের খোলামেলা ছবি পাঠিয়ে আকৃষ্ট করতো বেপরোয়া তূর্ণা

ডেস্ক রিপোর্ট : তারকা হোটেল থেকে নিজ বাসা। সর্বত্রই বেপরোয়া। যখন তখন আড্ডা। মদের নেশায় মাতাল হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলতো সে আড্ডা। ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রভাবশালীদের সঙ্গে। বেপরোয়া জীবন যাপনে প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থের। তাই সহজেই মিশে যায় অন্ধকার জগতে। প্রতারক চক্রের হয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে।

তূর্ণা আহসান নামে পরিচিত এই তরুণী। তার আরেক নাম রাহাত আরা খানম তূর্ণা। এই চক্রে অন্তত দুই শতাধিক দেশি-বিদেশি সদস্য রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তূর্ণাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে রাখা হয়েছে কাশিমপুর কারাগারে। শিগগিরই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি।

জানা গেছে, মিরপুর-১০ এর তিন নম্বর রোডের বেনারশি পল্লীর ৩৯/ডি২ বাড়ির ১০ তলায় থাকতো প্রতারক চক্রের নাইজেরিয়ান সদস্যরা। দ্বিতীয় তলা ব্যবহার করতো অফিস হিসেবে। চারতলায় থাকতো তূর্ণা। ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতো সে। বাসা ভাড়া নেয়া হয় নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের নামে। এছাড়াও মিরপুর ১১-এর সি ব্লকের পাঁচ নম্বর এভিনিউয়ে ছিল চক্রের আরেক আস্তানা। রাত হলেই তূর্ণার বাসায় জমতো আড্ডা। নাইজেরিয়ান ও দেশি বন্ধুদের মিলনমেলায় পরিণত হতো তার বাসা। কখনো কখনো নাচ, গানে মেতে উঠতো তারা। মদ ও সিসায় বুঁদ হয়ে থাকতো সবাই। ওই আড্ডায় অংশ নিতো তানিম নামের এক যুবক ব্যবসায়ী। তূর্ণার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওই যুবককে রাত-বিরাতে ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন প্রতিবেশীরা। তানিম ছাড়াও সুফি ফারুক নামে আরেক যুবকের সঙ্গে তার রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এরকম অনেক যুবকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই তূর্ণার উদ্দেশ্য থাকতো টাকা।

বিত্তশালী বন্ধুদের খোলামেলা ছবি পাঠিয়ে আকৃষ্ট করতো তূর্ণা। সেই সঙ্গে আবেগপ্রবণ কথা বলার এক পর্যায়ে টাকা খুঁজতো। প্রায়ই বাসার আসবাবপত্র কেনার জন্য ঘনিষ্ঠদের কাছে টাকা চাইতো। বিভিন্ন উৎসবে গিফট চাইতো। একই প্রয়োজনের কথা বলে অনেকের কাছে টাকা খুঁজতো। এমনকি বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও মিথ্যা বলে টাকা আদায় করতো। গ্রেপ্তারের পর সিআইডিকে এরকম নানা তথ্য দিয়েছে সে। নেত্রকোনা জেলা সদরের দক্ষিণ নাগড়ার ৪০ নম্বর বাসার আহসান উল্লাহর মেয়ে তূর্ণা। বাবার চাকরির সুবাদে তূর্ণার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। পরবর্তীতে লেখাপড়া করেছে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী থাকাবস্থায় গুরুকুল নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে তূর্ণা। ওই সময়ে পরিচয় হয় প্রভাবশালী কয়েক জনের সঙ্গে। জড়িয়ে যায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা ও সাবেক এমপির ছেলে, তিনি নিজেও আওয়ামী লীগের একটি উপ-কমিটির সদস্য। প্রায়ই টকশোতে কথা বলেন। তূর্ণার সঙ্গে তার দহরম মহরমের তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারের কিছুদিন আগেও তূর্ণাকে একান্তে ডেকেছিলেন তিনি। ওই সময়ে প্রতারণার কাজে ব্যস্ত তূর্ণা করোনার দোহাই দিয়ে তাকে এড়িয়ে যায়।

তূর্ণার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। মা-বাবার অবাধ্য হওয়ার কারণে পারিবারিক সালিশও হয়েছে কয়েক বার। কিন্তু কোনোভাবেই ফেরানো যায়নি তাকে। সরকারি দলের প্রথম সারির প্রভাবশালী এক নেতার সঙ্গে ২০১৭ সাল থেকেই তূর্ণার পরিচয়। একজন তরুণ উদ্যোক্তার মাধ্যমে শুরুতে তার কাছে যাওয়া-আসা করতো সে। এসব পরিচয় ব্যবহার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে এই তরুণী। প্রায়ই তারকা হোটেলে আড্ডা, শপিং, দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করতো তূর্ণা। চাকরির সীমাবদ্ধ টাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। ২০১৮ সালে অন্ধকার জগতে পা রাখে। ওই বছর নিউ মার্কেট এলাকায় নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের সঙ্গে পরিচয়। ডেনিস ও জুসেফের সঙ্গে সহজেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার।

ডেনিসের হাত ধরেই প্রতারক চক্রের সঙ্গে মিশে যায় সে। ওই চক্র প্রতিদিন আট থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো বিভিন্নজনের কাছ থেকে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের পুরনো ফেসবুক আইডি হ্যাক করতো এই চক্র। চক্রের সদস্যরা অন্তত দুই শতাধিক আইডি হ্যাক করেছে। এরমধ্যে আহসান উল্লাহ, মো. শামসুল হক, মো. বাবু, মো. রবিউল, মো. শরাফত উদ্দিন, মো. শামীম হোসেনসহ বিভিন্ন নামের আইডি রয়েছে। আইডি হ্যাক করে নাম ও ছবি পরিবর্তন করা হয়। সেইসঙ্গে পোস্টগুলো এডিট করে ভিন্ন লেখা দেয়া হয়। পুরাতন আইডি ও বিপুল মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকার কারণে টার্গেটকৃতের বিশ্বাস অর্জন সহজ হয়। এসব আইডি থেকে সাধারণত মার্কিন আর্মি পরিচয়ে বন্ধুতা করে চক্রের সদস্যরা। নারী আর্মি, ব্যবসায়ীও সাজতো এই চক্রের সদস্যরা। চ্যাট করতো। কখনো কখনো ভয়েস ম্যাসেজ দিলেও অডিও ও ভিডিও কল এড়িয়ে যেতো নানা অজুহাতে।

বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে বিপুল অর্থের গিফট সামগ্রীর এয়ারলাইন্স বুকিংয়ের ভুয়া ডকুমেন্ট পাঠায়। গিফট বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানায়। এক পর্যায়ে কাস্টমস কমিশনার সেজে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কল করে তূর্ণা। জানানো হয় পার্সেল এসেছে। এতে স্বর্ণ ও ডলার রয়েছে। শুল্ক পরিশোধ করে নিতে হবে। বিপুল টাকার গিফটের আশায় সহজেই তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতেন অনেকে। এই টাকা নেয়া হতো ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের একাউন্টে।

গ্রেপ্তারের পর তূর্ণা সিআইডিকে জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে গরিব লোকদের দিয়ে একাউন্ট করাতো তূর্ণা। তারপর স্বাক্ষরসহ চেক বই নিয়ে যেতো তারা। এসব একাউন্টে টাকা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই উত্তোলন করা হতো। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে গত ২১শে জুলাই তূর্ণাসহ ১৩ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন নাহার বলেন, অন্তত দুই বছর আগে এই চক্রের হয়ে কাজ করছে তূর্ণা। সে বেপরোয়া। এই চক্রের সদস্যরা ঘনঘন ফোন পরিবর্তন করতো। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সচেতন ছিল। তাই দীর্ঘদিন তাদের কেউ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সিআইডি তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতারকদের ব্যবহৃত ব্যাংকের ৩৫টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ, ভারতের রাজস্থান, কলকাতা, কুয়েত, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই চক্রের এজেন্ট রয়েছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই চক্রের প্রতারণার শিকার। এ বিষয়ে তাদের পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি। উৎসঃ মানবজমিন

ad

পাঠকের মতামত