334392

বরফে চাপা পড়া প্রা’ণঘাতি ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া ফিরতে পারে!

নিউজ ডেস্ক।। ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া; মানুষের সঙ্গে নিবিড় সঙ্গে রয়েছে এই দু’টি অনুজীবের। দু’একটি ব্যাক্টেরিয়া মানুষ ও মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর হলেও প্রায় সব ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়াই ক্ষ’তিকর।

খালি চোখে অদৃশ্য এই অনুজীব দু’টি বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে মহামারির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, মৃ’ত্যুর পথে মানুষকে করে ফেলেছে নিরুপায়। জলা’তঙ্ক, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, সার্স, ডেঙ্গু, ইবোলা আর বর্তমানের করোনা; এদের সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও জানি, কয়েকটিকে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও বের হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে।

কিন্তু আমরা কি সঠিকভাবে জানি পৃথিবীতে কত রকমের (প্রজাতি) ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া আছে আমাদের আশেপাশে, পৃথিবীতে? এসব অনুজীব কতভাবে তাদের রূপ বদল করে (মিউটেশন)।

এই অদৃশ্য ঘাটতকদের হাত থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করতে শত শত হাজার হাজার বছর ধরে কাজ করে আসছেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। সেই যে চীন দেশ সর্বপ্রথম ১০ম শতাব্দীর শুরুতে ভ্যাক্সিনেশন এর আদিরূপ ভ্যারিওলেশন (Variolation) আবিষ্কার করে। ধীরে ধীরে তুরস্ক এবং ইংল্যান্ডেও ভ্যারিওলেশন বিস্তার লাভ করে। আর ১৭৯৬ সালে আধুনিক ভ্যাক্সিন (টিকা) আবিষ্কার করেন বৃটিশ চিকিৎসক ডা. অ্যাডওয়ার্ড জেনার। এদিকে, ১৯২৭ সালে লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে কর্মরত অণুজীব বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করেন অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’। অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত কাজ করে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে; এছাড়া এটি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অন্যান্য অনুজীব বা রোগের আ’ক্রমণও রুখে দিতে কার্যকর। আর টিকা বা Vaccine হল এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ বা মিশ্রণ যা অ্যান্টিবডি তৈরি প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে দেহে কোন একটি রোগের জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতা জন্মাতে সাহায্য করে। এভাবে টিকা ও অ্যান্টিবায়োটিক এভাবে ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়াসহ রোগ জীবানুর হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে মানব সমাজকে।

এভাবে, একিদকে যেমন নতুন টিকা-অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করছেন বিজ্ঞানীরা অন্যদিকে নতুন নতুন ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস সামনে আসছে হু’মকির কারণ হয়ে। তাই মানুষের সঙ্গে অদৃশ্য কিন্তু ভীষণ শক্তিশালী এসব অনুজীবের যুদ্ধটা অসমাপ্তই থেকে গেছে, যাচ্ছে।

এর মধ্যে আবার পৃথিবীর উষ্ণায়ন নতুন করে জানান দিচ্ছে আরও অনেক ভয়ঙ্কর পূর্বাভাসের। বিজ্ঞানীদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে হিমবাহ (বরফের বিরাট চলমান স্তুপ বা নদী) গলছে, তাতে হাজার বছরের পুরনো প্রাণঘাতি ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া আবারও ফিরে আসতে পারে আ’তঙ্ক হিসেবে।

তারা বলছেন, বরফের নিচে বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে আছে অনেক মানুষ আর প্রাণির মৃতদেহ। সেই সঙ্গে চাপা পড়ে আছে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়াও। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফাঞ্চলের উপরিভাগ গলার পর এর গভীর স্থানগুলোও গলতে শুরু করেছে। বরফের গভীরতম স্থানকে বলা হয় ‘পার্মাফ্রস্ট’। এই পার্মাফ্রস্টেই চাপা পড়ে আছে প্রাচীন অনেক ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া। এগুলো গলতে শুরু করলে মানুষ আবারও সং’ক্রমিত হতে পারে ‘বিলুপ্ত’ ধরে নেয়া এসব অনুজীবের আক্রমণে।

২০১৬ সালের আগস্টে আর্কটিক অঞ্চলে সাইবেরিয়ার একটি স্থানে ১২ বছর বয়সী এক কিশোর অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, ৭৫ বছর আগে সেখানে একটি রেইনডিয়ার (হরিণ) অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, ওই হরিণের শরীর থেকে যায় পার্মাফ্রস্টেই। ২০১৬ সালের অতিরিক্ত গরমে ওই পার্মাফ্রস্ট গলে রেইনডিয়ারের শরীরের অংশ বেরিয়ে পঁচে গলে আশপাশের পানি আর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে খাবারে পৌঁছে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয় আরও ২ হাজার রেইনডিয়ার এবং কয়েকজন মানুষ।

প্রতি বছরের গ্রীষ্মে পার্মাফ্রস্টের গভীরতম স্থানের ৫০ সেন্টিমিটার করে গলে যায়। এর ওপর আবার বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পার্মাফ্রস্টের গভীরতম স্থানের গলন বৃদ্ধি করেছে। পার্মাফ্রস্টের বরফ আচ্ছাদিত মাটি আবার ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার হাজার বছর বেঁ’চে থাকার উত্তম স্থান। এর মানে হল বরফ গলা মানেই রোগের প্যান্ডোরা বাক্স খুলে যাওয়া। বিশ্ব উষ্ণায়নে আর্কটিক অঞ্চলের তাপমাত্রা বিশ্বের যেকোন স্থানের তুলনায় ৩ গুণ দ্রুত বাড়ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পার্মাফ্রস্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন, এখানে অক্সিজেন নেই। বিংশ শতাব্দীতে প্রায় ১০ লাখ রেইনডিয়ার অ্যানথ্রাক্সে মারা যায়, মাটির উপরিভাগে মৃ’তদেহগুলো কোন রকমভাবে মাটিচাপা দেয়া হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, মহামারি সৃষ্টি করা ভাইরাসগুলো বহু বছরের পুরনো পার্মাফ্রস্টে চাপা পড়ে থাকতে পারে।

আবার বরফের নিচে শুধু প্রাণির মৃতদেহ নয়, সমাহিত করা হতো মানুষের মৃতদেহও। ১৯১৮ সালের ভয়াবহ সং’ক্রামক স্প্যানিশ ফ্লু’র আরএনএ (রাইবোনিউক্লিয়িক এসিড) আলাস্কা থেকে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেখানে স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত অনেক মানুষের মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। স্মলপক্স আর বুবনিক প্লেগে আ’ক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের মৃ’তদেহ সাইবেরিয়ায় সমাহিত করা হয়েছিল। সেই মৃ’তদেহে স্মলপক্স ভাইরাসের ডিএনএ’র (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) কিছু অংশ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৮ আর ১৯ শতাব্দীতে আ’টকা পড়া প্রা’ণঘাতি সেই ভাইরাসগুলো বরফ গলতে শুরু করলে আবারও ফিরে আসতে পারে।

নাসার বিজ্ঞানীরা ২০০৫ সালে আলাস্কায় প্লেইস্টোসিন (প্রায় চব্বিশ লাখ বছর আগের যুগ) যুগের কারনোব্যাক্টেরিয়াম (গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়ার একটি প্রজাতি) ও প্লেইস্টোসেনিয়াম ব্যাক্টেরিয়া বরফ আচ্ছাদিত পুকুর থেকে জীবিত করেছেন। নাসার ওই গবেষক দল অ্যান্টার্কটিকার বিকন আর মুলিনস ভ্যালির বরফের নিচ থেকে ৮০ লাখ বছর পুরনো ব্যাক্টেরিয়াও সক্রিয় (জীবিত) করেছেন। তবে সব ভাইরাস কিংবা ব্যাক্টেরিয়া জীবিত হতে পারে না। যেগুলো শরীরের ওপরে শক্ত আবরণ তৈরি করতে পারে, সেগুলোই বরফের মধ্যে টিকে থাকতে পারে।

তবে পার্মাফ্রস্ট গলার পেছনে বিশ্ব উষ্ণায়নের পাশাপাশি আর্কটিক সাগর গলতে থাকায় সাইবেরিয়া যাওয়ার পথ ধীরে ধীরে সহজ হওয়াও দায়ী। কারণ, জ্বালানি তেল-গ্যাস উত্তোলন, খনিজ ধাতু উত্তোলনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বরফাচ্ছাদিত সাইবেরিয়াকে। এ কার্যক্রমে আরও দ্রুত গলছে পার্মাফ্রস্ট। তাই মানবজাতিকে যেকোন বড় বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

২০১৪ সাল থেকে বরফাঞ্চলের পার্মাফ্রস্টে মানুষকে সং’ক্রমিত করতে পারে, এমন ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার খোঁজ করছেন বিজ্ঞানীরা। ২০১৭ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা ১০ থেকে ৫০ হাজার বছর পুরনো অনুজীব পেয়েছেন মেক্সিকোর একটি খনির পাথরে। এমনকি ৪০ লাখ বছর ধরে মাটির ওপরে নেই, এমন ব্যাক্টেরিয়াও পাওয়া গেছে নিউ মেক্সিকোর একটি গুহায়। এই ব্যাক্টেরিয়াটি ১৮ ধরনের প্রতিষেধক প্রতিরোধী। অনুজীববিজ্ঞানীরা এমন অনুজীবের অস্তিত্বও পেয়েছেন, যেগুলো জীববৈচিত্র্য সৃষ্টির আগে থেকেই পৃথিবীতে আছে। যেগুলোতে পানি কিংবা সুর্যের আলো কোনটাই পৌঁছায়নি এখনও। এসব ‘জীবানুবাহক’ ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস মানুষের শরীরে কোনদিন প্রবেশই করেনি। তাই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এসব ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাসের জন্য প্রস্তুত নয়। সেটি মানুষের জন্য বড় হু’মকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ad

পাঠকের মতামত