312521

যেমন ছিল প্রাচীন মিশরীয় সমাজের নারী-পুরুষের সম্পর্ক

নারী-পুরুষের সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকেই কোনো না কোনো নিয়মের মধ্যেই চলে আসছে। তবে সব সভ্যতায় একই নিয়ম মানা হয়নি। সব সভ্যতা ও সমাজেই এই সম্পর্ক মেনে চলার মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। এসব ভিন্নতা আমাদের প্রাচীন অনেক সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে সাহায্য করে। চলুন তবে আজ জেনে নেয়া যাক প্রাচীন মিশরীয় সমাজের নারী-পুরুষের মানসিক, শারীরিক ও পারিবারিক সম্পর্ক কেমন ছিল সে সম্পর্কে কিছু তথ্য-

প্রাচীন মিশরীয় সমাজে গোত্র রক্ষা এবং ব্যক্তিগত অগ্রগতির নিমিত্তে বিবাহের সম্পর্ক তৈরি হতো। বর্তমান আধুনিক সমাজের মতোই সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে প্রেমের ভূরিভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন সমাজে। বিভিন্ন প্রাচীন শিলালিপি, দেয়ালচিত্র ও অন্যান্য উপকরণ থেকে বুঝা যায় প্রাচীন মিশরীয়রা সামাজিক বন্ধনকে গুরুত্ব দিয়েছে পারিবারিক শান্তিকে উৎসাহিত করতে। যদিও বিবাহের সম্পর্ক তৈরি হতো সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু নর-নারীর পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসাকেও গুরুত্ব দেয়া হতো।

বিভিন্ন স্তম্ভলিপি, শিলালিপি, সমাধিলিপি থেকে প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যে তখনকার সমাজে নর-নারীর সম্পর্কের একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। রোমান্টিকতা ছিল কবিতার মূল বিষয় ছিল, বিশেষ করে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৭০-১০৬৯ শতাব্দীতে। ওই সময়ে কোনো এক বিশেষ নারীকে উল্লেখপূর্বক তার গুণগান নিয়ে অনেক লেখা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে “দ্যা চেস্টার বেটি প্যাপিরাস আই” (খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০) উল্লেখযোগ্য। যেখানে স্পীকার বা বক্তা তার দূরসম্পর্কের এক বোনের কথা বলেছেন। নারীদেরকে সাধারণত বোন হিসেবে, একটু বয়স্ক নারীদের মা হিসেবে, একই বয়সী পুরুষদের ভাই এবং একটু বেশি বয়সী পুরুষদের পিতা হিসেবে গণ্য করা হতো। সেসময়ের লেখা “দ্যা চেস্টার বেটি প্যাপিরাস আই” এ বক্তা বা স্পিকার তার স্ত্রীর সৌন্দর্য বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সে সময়ের মিশরীয় নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন।

প্রাচীন মিশরীয় নারীদের পুরুষের সমান ভাবা হতো। তারা মনে করতো পৃথিবীর সৃষ্টির শুরুতে ওসেরিস (প্রাচীন মিশরের পরজীবন ও পুনর্জীবনের দেবতা) এবং আইসিস (ওসেরিসের স্ত্রী এবং প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের দেবী) পৃথিবী শাসন করতো। ধারণা করা হতো আইসিস নারী এবং পুরুষকে সমান শক্তিতে তৈরি করেছেন। তারপরও প্রাচীন সাহিত্যে পুরুষকে নিয়ন্ত্রণ শক্তি ধরা হয়েছে এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীকে বর্ণনা করেছে।

এমন এক লেখায় নারীদের “মিল্কি ব্রেস্টেড” বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু ককেশিয়ান নারী বলে নয়, একজন নারী যে কিনা মাঠে কাজ করে না, তার ত্বকের মসৃনতাকে বুঝাতে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে ঘর দেখাশোনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। উঁচু শ্রেণির নারীদের ঘরের বাইরে কম যাওয়া হতো। কারণ রোদে পোঁড়া ত্বক নিচু কৃষক শ্রেণির নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে। নিচু শ্রেণির মানুষদেরও উঁচু শ্রেণির মানুষদের মতোই প্রেম ভালোবাসার সমান অনুভূতি ও আবেগের অভিজ্ঞতা ছিল। প্রেম,ভালোবাসা ও বিয়ের ক্ষেত্রে বর্তমান আধুনিক সমাজের মতোই প্রাচীন মিশরীয় সমাজের সাদৃশ্যপূর্ণ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

ফারাও তুতেনখামেন বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত প্রাচীন মিশরীয় রাজা। যিনি আলোচনায় জায়গা পান তার প্রায় অবিকৃত সমাধির জন্য। এই সমাধিটি আবিষ্কৃত হয় ১৯২২ খৃষ্টাব্দে। ফারাও তুতেনখামেন (খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৫৩-১৩৩৬) যদিও খুব অল্প বয়সে সিংহাসনে বসেন। তবে তিনি সভ্যতাকে পূণর্গঠনে এবং ধর্মীয় বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তার এই প্রতিষ্ঠার পিছনে তার সৎ বোন এবং স্ত্রী আঙ্কসেনামানের অনেক অবদান রয়েছে। তাদের দু’জনের যৌথ প্রতিকৃতি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য রোমান্টিক প্রেমের প্রমাণ।

আঙ্কসেনামানকে সবসময় তুতেনখামেনের সঙ্গে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এটা সেসময়ের মিশরে ব্যতিক্রম কিছু নয়। কিন্তু দুজনের এই প্রতিকৃতিতে তাদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণের পরিষ্কার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তাদের আবেগ, হাতের ভঙ্গী, মুখের প্রকাশ সবকিছু বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় এই প্রতিকৃতিতে।

মিশরীয় সভ্যতার গবেষক জাহী হাওয়াস উল্লেখ করেন- তুতেনখামেনের সমাধীতে আঁকা তাদের দু’জনের প্রতিকৃতি থেকে এটা পরিষ্কার বুঝা যায় তাদের দুজন দুজনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল। আমরা এটা বুঝতে পারি যখন রানিকে রাজার হাতে ফুল তুলে দিতে দেখি কিংবা রাজার শিকারে তাকে সহচর হিসেবে দেখি। তুতেনখামেন আঠারো বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আঙ্কসেনামানকে ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপরও তাদের দুজনের পরস্পরের প্রতি আবেগের যে প্রকাশ তা মিশরীয় চিত্রকলায় আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়। তাদের ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গী এখন পর্যন্ত মিশরীয় চিত্রকলায় এবং শিলালিপির ইতিহাসে এক অন্য মাত্রা যোগ করে আসছে।

এমন এক আবেগঘন সমাধীলিপিতে এক ব্যক্তি তার প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে লিখেন- ভালোবাসা, তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তোমার মতো সুন্দর মুখ আমি কোথাও দেখি না। তোমার মধ্যে আমি কখনো কোনো খারাপ কিছু দেখিনি। এরকম অনেক শিলালিপিতে নারী পুরুষ সমান অংশীদারিত্যের সঙ্গী এবং বন্ধু হিসেবে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। পুরুষকে যদিও সংসারের কর্তা হিসেবে মান্য করা হয়, নারীও সহকর্মী হিসাবে সম্মানিত হয়ে থাকেন।

মিশরীয় সভ্যতার গবেষক এরিখ ফিচোট এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- নারীকে তার সঙ্গীর একাল এবং পরকালের সমান অংশীদার হিসেবে সমাধি অলংকরণে উপস্থাপন করা হতো। প্রাচীন মিশরীয় সমাজে যৌনতা নিয়ে কোন ট্যাবু ছিল না। জীবনের অংশ হিসেবেই যৌনতাকে দেখা হতো। তবে বিশ্বাসঘাতকতা ও অযাচারকে বর্জন করা হয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রেই ঘৃণা পুরুষের চেয়ে নারীর প্রতি বেশি দেখানো হতো। কারণ রক্তের সম্পর্ক নারীদের বহন করতে হতো।

ইতিহাসবিদ জন ই লুইস এ প্রসঙ্গে বলেন- প্রাচীন মিশরীয় সমাজে যৌনতা নিয়ে কঠোরতা ছিলনা। কিন্তু কোনো নারী বিবাহিত হলে বিশ্বস্ততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। যাতে সঠিক উত্তরাধিকারী নির্ণয় করা সম্ভব হয়। নারীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো বিধান ছিলনা। ব্যক্তিগত শাস্তি ছিল বিবাহবিচ্ছেদ অথবা শারিরীক নির্যাতন এমনকি মৃত্যু।

প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যে অবিশ্বাসী নারী চরিত্র বারবার এসেছে। “একজন অবিশ্বাসী নারীর ভাগ্য” নামক গল্পে তিনটি চরিত্র পাওয়া যায়। আনপু, ব্যাটা এবং আনপুর স্ত্রী। এই প্রাচীন গল্পেও নারীকে অবিশ্বস্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। পুরুষশাসিত সাহিত্যে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নারী চরিত্রকে হেয় করার আভাস পাওয়া যায়। অযাচার অবিশ্বাস্যতার দায় নারীর উপর চাপিয়ে তৈরি গল্প সে সময়ে জনপ্রিয় ছিল। আনপু, ব্যাটার গল্পে আনপুর স্ত্রীকে পোহাতে হয় নির্মম নির্যাতন এবং শেষে মৃত্যু। আধুনিক সমাজ এবং সাহিত্যেও একই দৃশ্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

ওসেরিস ও আইসিস, প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবী, যাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পৌরাণিক গল্প। ওসেরিস তার ভাই সেটের হাতে নিহত হন। সেটের স্ত্রী নেপথিস, আইসিসের রূপ ধারণ করে ওসেরিসকে প্রলুব্ধ করে। এ ঘটনায় সেট ক্ষুব্ধ হয়ে ভাই ওসেরিসকে খুন করে। এই অগ্রহণযোগ্য প্রেমের উপর ভিত্তি করে তৈরি গল্প তখন ভীষণ জনপ্রিয় ছিল।

সমকামিতার ব্যপারেও প্রাচীন মিশরীয় সমাজে কোন ট্যাবু ছিল না। মনে করা হয় রাজা দ্বিতীয় পেপি (২২৭৮-২১৮৪ খ্রীষ্টপূর্ব) একজন সমকামী ছিলেন। অবিবাহিত নারীদের নিজের ইচ্ছেমত যৌন সম্পর্ক করাতে কোন আপত্তি ছিল না। ভার্জিন বলে কোন শব্দ তখন ছিল না। পতিতাবৃত্তি নিয়েও কোনো বাধা ছিল না। তবে, পতিতাবৃত্তির প্রমাণ কোনো লিপিতে পাওয়া যায়নি।

স্থায়ী এবং টেকসই সমাজের জন্য একক স্থায়ী পরিবার দরকার বলে প্রাচীন মিশরীয় সমাজ মনে করতো। রাজ পরিবারগুলোতে যদিও রক্তের সম্পর্কে বিয়ে হতো কিন্তু এর বাইরে রক্তের সম্পর্কের বিয়ে অনুৎসাহিত করা হতো। সাধারনত মেয়েদের বারো এবং ছেলেদের পনেরতে বিয়ে হত। গড়পড়তা মেয়েদের ১৪ এবং ছেলেদের ১৮ বা ২০ ছিল বিয়ের বয়স। ছেলেরা ছেলেরা এর মধ্যে পিতার ব্যবসা শিখে নিত।

ইতিহাসবিদ চার্লস ফ্রিম্যেন উল্ল্যেখ করেছেন- মিশরীয় সমাজে জীবনের একক হলো পরিবার। দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্যে আমরা সুখী দম্পতিদের বাহু জড়িয়ে থাকতে এবং বয়স্কদের প্রতি তরুণদের যত্ন নিতে দেখি।

ad

পাঠকের মতামত