305780

প্রান্তিক ‍কৃষকের অভিজ্ঞতা : মাঠে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন, তারপরও ক্ষতি

পেঁয়াজের চাষ করতে গিয়ে এবছরের শুরুতে রাম ধরা খেয়েছিলাম। নিজেদের সামনে নিজেদেরই ছুঁড়ে দেয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। নিয়ন্ত্রিত ও ছোট পরিসরে চাষাবাদের বাইরে এসে, প্রকৃত কৃষকের মাঠের পাশেই জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, একই পরিমাণ জমি থেকে তাঁদের সমান ফসল সংগ্রহ করা। প্রাণবন্ত গাছের চেহারায়, আমাদের পেঁয়াজের ক্ষেত সকলের সেরা হল। তবু ধরা খাওয়া আটকানো গেল না। বাংলার গীতিকাররা নারীর বেদন বুঝতে বনমালীকে পরজনমে রাধা হতে অনুরোধ করেছেন। আমি আর আমার ভাই, মাথায় হাত দিয়ে গাইলাম, ‘হায়! বুঝিবে তখন তুমি, কৃষিরও বেদন…শ্যাম রায়…

পেঁয়াজ কলি আসার দিনগুলোতে আমরা খুব উত্তেজিত ছিলাম। ভাতের পাতে নতুন তরকারি। দরকারি কথাটা তখনও অজানা। পেঁয়াজ হচ্ছে রূপান্তরিত কাণ্ড। তাই কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন কৃষককে পেঁয়াজ চাষের সময় মূল কাণ্ড বা কলিকে যতদ্রুত সম্ভব ক্ষেত থেকে অপসারণ করতে হবে। তা না হলে, কাণ্ডটি মাটির তলে নয়, উপরেই ফুলে ফেঁপে উঠবে। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় দেখা যাবে, যতটুকু লাগানো হয়েছিল, সাইজ তার চেয়ে ছোট হয়ে গেছে।

যে পরিমাণ জায়গাতে পেঁয়াজ লাগিয়েছিলাম, দুই ভাইয়ের পক্ষে সেখান থেকে সমস্ত কলি তুলে ফেলা সম্ভব ছিল না। ফলে এক চাষি ভাইকে অনুরোধ করলাম, কলি তুলে বিক্রি করে দিন। আমাদের কিছু দিতে হবে না। যা হবে আপনিই নেবেন। তিনি রাজি হলেন বটে, তবে সমস্যার সমাধান হল না। কৃষক ধরা খাওয়া বাজার ব্যবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় ছিল ভাসা ভাসা।

দেখা গেল, ঐ কৃষক সারাদিন মাঠে শ্রম দিয়ে যে পরিমাণ কলি সংগ্রহ করতে পারেন, তাতে তাঁর দিন মজুরি ওঠে না। পাইকাররা পেঁয়াজ কলির আঁটি ২ টাকাতে নামিয়ে এনেছেন। অগত্যা ৪৫০ টাকার মজুরিতে ৪ জন কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করতে হল।

পেঁয়াজ কলি তোলা শেষে যখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছি, তার মাত্র কয়েকদিন পরেই দেখলাম, মাঠ আবার পেঁয়াজ কলিতে ভরে উঠেছে। আবারও একই প্রক্রিয়া। তারপর আবার। পেঁয়াজ না কেটেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

আনন্দের বিষয় হচ্ছে- পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় দেখা গেল, এতো টানা পোড়েন, সময় ক্ষেপণ, সঠিক সময়ে পেঁয়াজ কলি তুলতে না পেরেও রাসায়নিক পদ্ধতিতে চাষ করা মাঠের চেয়েও আমাদের মাঠে ফলন বেশি হয়েছে। ১৩ শতাংশ জায়গাতে প্রায় ১৫ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি। কিন্তু এরপর দ্বিতীয়বারের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হল। এতো পেঁয়াজ কি করব?

সংরক্ষণের উপায় নেই। প্রতিদিনই পঁচতে থাকবে। অনেকেই এগিয়ে আসলেন সাহায্য করতে। কিন্তু কেউই কেজিতে ১০ টাকার বেশি দাম দিতে চান না। কারণ বাজারেও ঐ দাম। এদিকে পেঁয়াজ উত্তোলন, আগা কাটা, রোদে শুকানো, গা থেকে মাটি পরিষ্কার করতে ও ঝাড়তেও অনেক শ্রম ও টাকা বেরিয়ে গেছে। শিখলাম যে, বাম্পার ফলনে একমাত্র বিটিভির কৃষকের মুখেই হাসি ফুটতে পারে। রাগে আমাদের রক্ত ফুটছিল। এরপর ১০ টাকা করেও সব পেঁয়াজ বেচা গেল না। প্রায় আট মণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেল, নিজেদের জন্য ছ’মাসের রাখলাম। বাকিটা বিলি করলাম।

পেঁয়াজের দাম বাড়তি থাকায়, এবছর চাষিরা মাঠের পর মাঠ পেঁয়াজ লাগিয়েছেন। তাঁদের ধরা খাওয়ার দিনও সমাগত। খুব অবাক লাগে একারণে যে, সার বীজের দোকান থেকে শুরু করে খুচরা বাজার হয়ে আমাদের ঘরে যে কোন ফসল পৌঁছানো পর্যন্ত যতগুলো পর্যায় বা স্টেক হোল্ডার আছে- সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হন একমাত্র কৃষক। আর কেউ না। একথা আমাদের কৃষকরা জানেন না এমন মনে করার কোন কারণই নেই। তবু তাঁরা চাষ করবেন, আমাকে আপনাকে খাওয়াতে।

তাঁদের বেদনা বুঝতে বনমালী তুমি ফেসবুকে মাছের মায়ের পুত্রশোক সুলভ আহা উহু না করে, পরজনমে হইয়ো কৃষক। মনে রাখা দরকার, যে কৃষক ১০ টাকা দরে তার ক্ষেতের ফসল বিক্রি করেছে, এই সিস্টেমে পড়ে- সেও আজ ২০০ টাকা করেই পেঁয়াজ কিনছে তাঁর পরিবারের জন্য।

মাঠ পর্যায়ে কাজের মাধ্যমে আমাদের উপলদ্ধি হচ্ছে, সহজ কিছু উপায় অবলম্বন করে পেঁয়াজের উৎপাদন ও বিপণন সংকট থেকে কৃষক ও কৃষিকে রক্ষা করা সম্ভব। এর একটি হচ্ছে, সরাসরি বীজ থেকে পেঁয়াজ চাষের জন্য চাষিকে উৎসাহিত করা। কারণ সরাসরি বীজ থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজে কলি আসে না। ফলে মাঠ পর্যায়ের উৎপাদনে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হয় এবং এই পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ কৃষকের বাড়িতেই সারা বছর সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে এর জন্য সব অঞ্চলে পেঁয়াজের বীজ সহজলভ্য ও মূল্য কৃষকের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে।

আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে- সংরক্ষণের সুযোগ বাড়ানো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রদানকৃত তথ্য অনুযায়ী দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন। একই উৎস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় যে, এর মধ্যে দেশেই প্রায় সাড়ে ২১ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। তবে যথাযথ সংরক্ষণের সুযোগ না থাকা, পেঁয়াজ শুকিয়ে যাওয়া, পরিবহনজনিত স্থানান্তর এর কারণে প্রায় ৮ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়। ফলে প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ লক্ষ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানী করার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ চাহিদার প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমদানি নির্ভর। কিন্তু সংরক্ষণ সুবিধা বাড়িয়ে এই ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব।

ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলায় এই কাজ দুটি জরুরি কিন্তু এরচেয়েও জরুরি ও উৎকট বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংকট মোকাবেলার সদিচ্ছার অভাব। গত কয়েক মাসের পেঁয়াজকাণ্ডে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে একথা পরিষ্কার হয়েছে যে, জনগণের স্বার্থ রক্ষা সম্পর্কে রাষ্ট্রের লক্ষ্যণীয় উদাসীনতা রয়েছে। প্রান্তিক কৃষকের প্রতি উদাসীনতা তো আরো চরম। বাংলাদেশ না’কি কৃষি উন্নয়নে রোল মডেল। আমরা বলি সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের মতো এও এক ঢোল মডেল। সরকারের বাজানো বাদ্যি। কৃষকের উন্নয়ন বাদ দিয়ে কৃষির উন্নয়ন সম্ভব- এ ভাবনা অবান্তর।

লেখক: কৃষক, আইসিটি গবেষক ও পরিবেশ কর্মী

ad

পাঠকের মতামত