303810

ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে বুয়েটে পড়াতেন আকাশের বাবা, এখন মিলছে না আইনজীবী

বাবা রিকশা চালক। মা ছিলেন গৃহিণী। দুজনের কারোরই তেমন অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তাদের সব স্বপ্ন ছিল তিন ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় করবেন। ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মো. আকাশ হোসেন।

পরীক্ষা দিয়েছিলেন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েছিলেন আকাশ।

ভর্তি হন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। বুয়েটে “মানুষ মানুষের জন্য” নামের একটি দাতব্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা আর টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন আকাশ। স্বপ্ন ছিল একটাই- ছোট দুই ভাইবোনকেও ঠিকমতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। মা-বাবার কষ্ট দূর করে তাদের মুখে হাসি ফোটবেন।

আকাশ হোসেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। আকাশ দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি ও জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ নিয়ে পাশ করলে ভ্যানচালক বাবা আতিকুল ইসলাম ও মা নাজমা বেগমের ছেলের উচ্চশিক্ষা লাভের আশা বেড়ে যায়।

প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার উপার্জন আর স্কুল থেকে পাওয়া উপ-বৃত্তির টাকায় পড়েছেন। স্কুলে থাকতে কখনো কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কলেজে থাকার সময় শিক্ষকরা বিনা পয়সায় তাকে পড়াতেন।

২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর ‘দৈনিক প্রথম আলোয়’ ‘নিজেরে করো জয়’ শিরোনামে ছাপা হওয়া গল্পে এমনই কথা লিখেছিলেন মো. আকাশ হোসেন। সেই আকাশ (২১) এখন বুয়েটের আরেক মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা মামলার ১৩ নম্বর আসামি। গত রবিবার রাতে বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার সময় ও পরে লাশ রুম থেকে সরিয়ে সিঁড়িতে নেয়ার সময় সিসিটিভির ফুটেজে আকাশকে দেখা গেছে।

জানা গেছে, টাকার অভাবেই কোনও আইনজীবী ধরতে পারেননি ভ্যানাচালক এই বাবা। তিনি বলেন, ‘টাকা-পয়সা পকেটে না থাকার কারণে আমরা এখনও পর্যন্ত কোনও আইনজীবী ধরতে পারিনি।’

আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিদিন আদালতে যাই, আর ফিরে চলে আসি। আমি পেশায় একজন ভ্যানচালক। বাড়ি জয়পুরহাট জেলার দোগাছি ইউনিয়নের দোগাছি গ্রামে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকা ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলাম বুয়েটে। আশা ছিল, অভাবের সংসারে এক সময় পূর্ণতা আসবে আকাশের হাত ধরে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আকাশ সংসারের হাল ধরবে। তবে এমন কাজ আমার ছেলে করতে পারে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আতিকুল বলেন, ‘সব স্বপ্ন শেষ। এখন স্বপ্নপূরণ তো দূরের কথা, জীবনটাই বাঁচানো দায় হয়ে পড়ছে। পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায়, চোখেমুখে সব ঝাঁপসা দেখতেছি।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেকে বুয়েটে পাঠায়ছিলাম ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। নিজে না খেয়ে তার জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছি, আজকের এই দিনটি দেখার জন্য না!’

আকাশের বাবা আরও বলেন, ‘আকাশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সদস্য, এটা জানতাম না। তবে ছেলেকে রাজনীতিতে জড়িত না হতে বারবার নিষেধ করেছিলাম। সে যদি আমার কথা শুনতো তাহলে আজ এ পরিস্থিতি হতো না।’

তিনি বলেন, ‘পুরো জয়পুরহাট জেলার লোক তার সুনাম করছিল। মেট্রিক-ইন্টারে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। এলাকার মানুষ তার লেখাপড়ায় নিজ থেকে সহযোগিতা করেছে। আজ সব শেষ হয়ে গেল।’

দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আকাশের বাবা ভ্যান চালিয়ে ও ইউনিবাসীর সহযোগিতায় ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিল। আকাশের প্রতি এলাকার জনগণ এতটায় খুশি যে, সে অথবা তার পরিবার কখনো এমন কোনও কাজের সাথে জড়িত ছিল না। তার পরিবার গরিব, তারা নৌকায় ভোট দিতো। এর বাইরে কোনও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘এলাকার লোকজন আকাশের জন্য মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করেছে। ছেলেটা যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্‌ পাক যেন তাকে রেহাই দেন। এখনও এলাকাবাসী তার প্রতি সন্তুষ্ট আছে এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে সে এই কাজের সঙ্গে জড়িত না।’

চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সরাসরি এই ব্যাপারটা দেখছেন তাই আমরা চাচ্ছি যারা জড়িত তারা শাস্তি পাক। আর যারা নির্দোষ তারা সবাই মুক্তি পাক।’

প্রসঙ্গত, ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে আবরার ফাহাদকে রবিবার (৬ অক্টোবর) রাতে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শের-ই-বাংলা হলের নিচতলা ও দুইতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পরদিন সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ লাশের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, ছেলেটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

এ নিয়ে আবরার হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ১৬। বাকি চার জনকে আবরার হত্যায় জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। গ্রেফতার ১৩ জনের মধ্যে ইফতি মোশারফ হোসেন সকাল এরই মধ্যে আবরার হত্যায় অংশ নেওয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে ঘটনার সময়ে শেরে বাংলা হলের ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য আলামত থেকে ১৯ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আবরার হত্যায় তার বাবা বরকত উল্লাহও চকবাজার থানায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে তাদের আসামি হিসেবে মামলা দায়ের করেছেন। এজাহারভুক্ত আসামিদের প্রত্যেকেই বুয়েটের শিক্ষার্থী ও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন— মেহেদী হাসান (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৩তম ব্যাচ), মুহতাসিম ফুয়াদ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৪তম ব্যাচ), অনীক সরকার (১৫তম ব্যাচ), মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), ইফতি মোশারফ হোসেন সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), মনিরুজ্জামান মনির (পানিসম্পদ, ১৬তম ব্যাচ), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোজাহিদুল (ইইই, ১৬তম ব্যাচ), তানভীর আহম্মেদ (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ) , জিসান (ইইই, ১৬তম ব্যাচ), আকাশ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ), শাদাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ), তানীম (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৭তম ব্যাচ) ও মোয়াজ, মনতাসির আল জেমি (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিভাগ)।

ad

পাঠকের মতামত