303614

গোয়াল ঘরে শেকল দিয়ে বৃদ্ধা মাকে বেঁধে রাখেন ছেলেরা

বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের চরধুপতি এলাকার বাসিন্দা খবিরুন্নেসা (৭৫)। জন্ম দিয়েছেন দুই ছেলে এক মেয়ের। গর্ভের সন্তানগুলোকে আগলে রেখে লালন করলেও এখন তার জায়গা গোয়াল করে। মাকে মানসিক রোগী দাবি করে শেকল দিয়ে আটকে রেখেছেন সন্তানরা।

চরধুপতি এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ মাস ধরে খবিরুন্নেসাকে গোয়াল ঘরে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন তার ছেলেরা। তবে মাকে মাটিতে শুতে দেননি তারা। তার জন্য সেখানে বিছানা পাতা হয়েছে।

একদিন রশি খুলে মেয়ের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন খবিরুন্নেসা। কিন্তু যেতে পারেননি। ছেলেরা তাকে ধরে এনে একই স্থানে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে।

বয়সের ভারে কানে একটু কম শুনলেও খবিরুন্নেসা মানসিকভাবে স্বাভাবিক বলে জানান প্রতিবেশিরা। মূলত পৈত্রিক জমি-জমা ভাগ বাটোয়ারা হওয়ায় পরে ছেলেদের কেউ বৃদ্ধা মায়ের যত্ন নিতে রাজি নন। এ কারণে তাকে অবহেলায় গোয়াল ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। কোথাও যেন যেতে না পারেন সে কারণে কোমরে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওই গোয়াল ঘরেই দিনে একবার তাকে খাবার দেওয়া হয়।

গতকাল সোমবার রাত ১০টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি গোয়াল ঘরে বিছানায় শেকল বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। সেখানে বসে তিনি নাতি-নাতনিদের ডাকছিলেন। শেকলে বাঁধা থাকায় তিনি বিছানা ছেড়ে নামতেও পারছিলেন না। এমনকি মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মশারিরও কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে।

এ সময় গোয়ালঘরে লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে খবিরুন্নেসা পরিচয় জানতে চান। ছেলেদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা কারা বাবা? মোর পোলারা ভালো। হ্যারা মোরো ঠিকমতো খাওন-দাওন দেয়। মোর পোলাগো যেন কেনো সমস্যা না অয় বাবা।’

গোয়াল ঘরে শেকলে বাঁধা থাকলেও খবিরুন্নেসা তার সন্তানদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে চান না। ঠিক মতো তাকে খেতে দেওয়া হয় কী না জানতে চাইলে তিন সন্তানের জননী বলেন, ‘আমার পোলারা আপনাগো দোয়ায় মোরে ঠিকমতো খাওন দাওন দেয়। হ্যারা অনেক ভালো।’

কথা বলতে গেলে খবিরুন্নেসার ছোট ছেলে বাচ্চু জানান, তার মায়ের মাথায় সমস্যা আছে। তিনি বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন। তার মা যেন কোথাও চলে না যায় তাই বেঁধে রেখেছেন। খবিরুন্নেসাকে ঠিকমতোই ভরণপোষণ করছেন বলেও জানান বাচ্চু।

এ বিষয়ে বড় ছেলে বাদলের স্ত্রী বেবি জানান, তার শাশুড়ি মানসিক রোগী। সে কারণে তাকে ছেলেরা বেঁধে রেখেছেন।

প্রতিবেশী হুমায়ুন কবীর জানান, খবিরুন্নেসা দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মা। দুই বছর আগে স্বামী আবদুল হামিদ খান মারা যাওয়ার পর সহায় সম্পত্তি ছেলে-মেয়েরা ভাগ করে নেন। মায়ের ভরণপোষণ নিয়ে ছেলেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে এক বৈঠকে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় দুই ছেলে মিলে ভরণপোষণ করবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ছেলেদের কেউই ঠিকমতো মায়ের যত্ন নেননি। এছাড়া বিভিন্ন রোগে খবিরুন্নেসার শারীরিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে।

বিভিন্নজনের কাছে খবর পেয়ে খবিরুন্নেসাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন বরগুনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ। উদ্ধারের পর বরগুনা থানা পুলিশের কনস্টেবল রেজাউল গাজী খবিরুন্নেসাকে পরার জন্য দুটি জামা, প্রয়োজনীয় ওষুধ, একটি পাটি ও সাবান কিনে দেন। পরে মেয়ে তসলিমার জিম্মায় দেওয়া হয় তার মাকে।

গৌরিচন্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তানভীর হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে যথাসাধ্য সহায়তা দেওয়া হবে।’ এছাড়া তার ভরণপোষণ যাতে নিশ্চিত করা হয় সে বিষয়ে ছেলেদের ডেকে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। এসময় চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধাকে দুই হাজার টাকা দেন।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট জাকির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি চরম অমানবিক। এটি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া কিছু না। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে মেয়ে তাসলিমার জিম্মায় দিয়ে ছেলেদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছি। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বরগুনার (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘পুনরায় ছেলেরা যাতে তাদের মায়ের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ না করতে পারে তার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা বরগুনা জেলা প্রশাসন বৃদ্ধা মায়ের পাশে আছি। সেই সাথে তিনি যাতে তার ছেলেরা আর অবহেলা না করতে পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

ad

পাঠকের মতামত