302202

দেবী নয়, মাদারীপুরে গর্ভধারিণী মায়ের পূজা করলো সন্তানেরা

কণ্ঠশিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাসের উদ্যোগে শারদীয় দুর্গা পূজা উপলক্ষে মাদারীপুরের পূর্ব কলাগাছিয়ায় পৃথিবির বুকে একমাত্র জীবন্ত দেব দেবীর মন্দিরে অর্ধশতাধিক মাকে জ্যান্ত মাতৃ পূজা করেছেন তাদের সন্তানেরা।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্যতিক্রমী হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা উপলক্ষে ব্যতিক্রমধর্মী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

২০১৬ সাল থেকে শুরু করে গত ৪ বছর যাবত নকুল বিশ্বাস সাহিত্য সঙ্গীত একাডেমিতে এই পূজার আয়োজন করা হলেও এবার প্রথম জীবিত মায়ের পূজা দেয়ার জন্য একটি মন্দির তৈরি করেছেন যা কিনা পৃথিবির বুকে একমাত্র জীবন্ত দেব দেবীর মন্দির।

সব সময় মাটির প্রতিমাকে পূজা করা দেখে এবার নিজ গর্ভধারিণী মাকে পূজা দেওয়ার সংকল্প নিয়ে তিনি আশপাশ এলাকার ৫ গ্রাম থেকে অর্ধশত মাকে একত্র করে উৎসবমূখর পরিবেশে জ্যান্ত মাতৃ পূজা দেন। পৃথিবীর বুকে নকুল কুমার বিশ্বাসের একমাত্র প্রতিষ্ঠিত মাদারীপুর সদর উপজেলার পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামে জীবন্ত দেব-দেবীর মন্দীরে, সারি সারি চেয়ারে বসে আছেন অর্ধশত গর্ভধারিনী মা। প্রত্যেক মায়ের পদতলে হাটু গেড়ে বসে আছেন নিজ নিজ সন্তান ছেলে-মেয়ে।

হিন্দু ধর্মানুসারে মাটির তৈরী প্রতিমাকে পূজা অর্চনা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এবারের দুর্গা পূজার পঞ্চমীর দিন মাদারীপুরের পূর্ব কলাগাছিয়া গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী অর্ধশতাধিক মাকে ফুল, চন্দন, তুলসী, দুর্বা দিয়ে পূজা দিলো নিজ নিজ মায়ের সন্তানেরা। এ যেন মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ।

এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন পূর্ব কালাগাছিয়া, উত্তর কলাগাছিয়া, চৌহদ্দী, বাহাদুপুর, কমলাপুর, আড়ুয়াকান্দি, কেন্দুয়া, মাঠিভাঙ্গা ও চৌরশির প্রায় অর্ধশত মা। এসময় অনেক মা ও তাদের সন্তানদের চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে দেখা গেছে। পূজার শুরুতেই নকুল কুমার বিশ্বাসের সহধর্মিনী গৌরী বিশ্বাস প্রতিটি মায়ের হাতে পূজার নতুন কাপড় তুলে দেন।

ব্যতিক্রমী এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দূর দূরান্ত থেকে নানা বয়সের শত শত মানুষ ছুটে আসেন। পূজা শেষে উপস্থিত সকলের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। পরে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও এই পূজা দেখতে ভারতের কলকাতা থেকে বিভিন্ন অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

গ্রামবাসীর ভাষ্য, প্রতিটি সন্তান যদি তার মাকে প্রতিনিয়ত ধ্যানে জ্ঞানে পূজো করে তবে তাদের মধ্যে মাতৃভক্তি উদয় হবে। দেশে আর কোথাও কোন বৃদ্ধা আশ্রম থাকবে না। ফলে সন্তানের ভালোবাসায় মা চিরকাল হাসিখুশি থাকবেন। বিশ্বের প্রতিটি ঘরে এভাবে সন্তান তার মাকে ভালোবেসে পূজা করবে এটাই অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য বিষয় দেখে মনে হচ্ছে।

গীতা পুইস্তা বলেন, এই পূজার মাধ্যমে বুজতে পারলাম মা আমাদের পৃথিবির সবচেয়ে আপন তাকে বৃর্দ্ধাশ্রমে দেয়া যাবে না।

লিমা ও সুর্বণা প্ইুস্তা বলেন, মাকে সব সময় ভালবাসতে হবে তা ঠিক। তবে এই পূজা করে হৃদয়ে যে আবেক চলে এসেছে তা কাউকে বুঝানো যাবে না। মা তো মা তার তুলনা হয় না কখনো। এই পূজা দেখে সবার শিক্ষা নেয়া উচিত যারা মাকে বৃর্দ্ধাশ্রমে পাঠায়।

স্থানীয় শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, ‘আমি এতো বড় হয়েছি কিন্তু কখনো সবার সাথে একত্রিত হয়ে মায়ের পা ধরে পূজা করতে পারবো ভাবিনি। আমার মৃত্যু আগ পর্যন্ত আমি আমার বৃদ্ধা মায়ের পূজো করতে চাই।’

মা মিনারা রানী বাড়ৈ বলেন, যে সন্তানেরা ছোট থেকেই মাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা ভরে মায়ের সেবা করে দেবতারা তার পূজা করে। প্রতিটি ঘরেই ছোট থেকে ছেলে-মেয়েরা তাদের মা-বাবাকে ভক্তি, সম্মান করুক এটাই আমি চাই। জ্যান্ত মাতৃ পূজা এই ব্যতিক্রমী আয়োজন।

কলাগাছিয়া এলাকার বাসিন্দা এক মা কমলা পুইস্তা বলেন, ‘সন্তানের এমন ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছি যেন আমার সন্তান দীর্ঘজীবি হয়।’ আজ আমার পূজা করেছে ভবিশ্যৎ তার মেয়ে তার পূজা করবে।

ভারতের পশ্চিম বঙ্গের গায়ক, অভিনেতা ও গুরু চাঁদব্রান্ডের প্রতিষ্ঠাতা প্রদিপ মন্ডল বলেন, আমি জ্যান্ত মায়ের পূজা দেখে খুবই খুশি, এই পূজা কেন শুধু বাংলাদেশে হবে? আমি নকুল দাকে নিয়ে আমার মাধ্যমে ভারত বর্ষে এই পূজা শুরু করবো। ‘সব সময় মাটির প্রতিমাকে পূজা দেওয়া হয়। কিন্তু জ্যান্ত মায়ের পুজা হয় না। এই আয়োজন মা বাবার প্রতি সন্তান ও সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সেতু বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।’ বিদায় হবে বৃদ্ধাশ্রম।

জীবন্ত দেব দেবী মন্দীরের প্রতিষ্ঠাতা ও আয়োজক এবং সংগীত শিল্পি নকুল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের এই ব্যতিক্রমি আয়োজনের মূল কারণ যেন মা খুশি থাকেন। আমাদের এ পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু হতে পারেনা। মায়েদের জন্য নির্মিত প্রতিটি বৃদ্ধা আশ্রমকে আমরা বন্ধ করে দিতে চাই। ভালোবাসা দিয়ে মাকে তার সন্তাানের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।’ আমার মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথিবির বুকে কোন বৃদ্ধাশ্রম থাকবে না। মায়েরা সন্তানের কাছে থাকবে।

তিনি আরও বলেন, আমি যেদিন জেনেছি এক সাহাবী আমাদের প্রিয় বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মাদ(সঃ) কাছে এসে জানতে চেয়েছিল? আমি বাবা মায়ের মধ্যে প্রথম কার বেশী আদর যন্ত করবো? তখন বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) বলেছিলেন, তোমার মায়ের। এরপর পরপর তিনবার জানতে চেয়েছিল তার পরও সে বলেছিলেন তোমার মায়ের। এরপর আবার জানতে চাইলে তিনি পুণরায় বলেন তোমার বাবার। আমি এ থেকে বুঝছি মায়ের সম্মান সবার আগেই। বাবার সাথে শুধু রক্তের সর্ম্পক আর মায়ের সাথে নাড়ীর সর্ম্পক। দশ মাস দশদিন আমাদের গর্বে লালন-পালন করেছে। তারপর বড় হওয়ার আগপযন্ত আমাদের লালন-পালন করেছে। আমার একটাই ম্যাসেজ তোমরা কেউ তোমার মা-বাবাকে কষ্ট দিও না, তাদের বৃর্দ্ধাশ্রমে দিও না, মা-বাবাকে ভালবাসবো।

ad

পাঠকের মতামত