298456

২২ বছরে এমন বন্যা হয়নি

‘১৯৯৭ সালের পর কখনোই বাড়িতে পানি প্রবেশ করেনি। এর আগে যতবারই বন্যা হয়েছে, এলাকার মানুষ মহাসড়কের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এবার সেই সড়কেই হাঁটু থেকে কোমর পানি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মানুষ খেয়ে না খেয়ে আছে, চুলা জ্বালানোর জায়গাটুকুও শুকনা নেই।’

শুধু চন্দনাইশ নয়, টানা ১০ দিনের বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বাঁশখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী, বোয়ালখালী উপজেলার প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ গত এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করছেন তারা। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-বান্দরবান ও চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক।

 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার তিনটি নদীর পানি গত চারদিন ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর মধ্যে হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পানি বিপৎসীমা থেকে নেমে গেছে। দোহাজারী পয়েন্টে সাঙ্গু নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে প্লাবিত হয়েছে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলা।

ভয়াবহ বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাতকানিয়া উপজেলার মানুষ। টানা বৃষ্টিতে উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় সবগুলোই প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে নলুয়া, ঢেমশা, কেঁওচিয়াসহ ছয়-সাতটি ইউনিয়নের অবস্থা ভয়াবহ। এসব এলাকায় পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানি উঠেছে। সাঙ্গু নদীর পানি বিপৎসীমার দেড় মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

স্থানীয়দের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে শহরে ও আশাপাশের উপজেলার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার এবং পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে ওই এলাকায়। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছে মানুষ। ফসলের ক্ষেত, গোলার ধান, মৎস্য খামার, পশু ও বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর।

 

এদিকে বন্যার পানি পল্লী বিদ্যুতের সাব-স্টেশনে ঢুকে পড়ায় গত চারদিন ধরে উপজেলার কেঁওচিয়া, সোনাকানিয়া, মাদার্শা ও আমিলাইশ ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ‘রোববার (১৪ জুলাই) সাঙ্গু নদীতে বিপৎসীমার দেড় মিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় সবগুলো ইউনিয়ন প্লাবিত। বানভাসি মানুষের মাঝে ইতোমধ্যে ৯৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে ৮০০ শুকনো খাবারের প্যাকেট এবং উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে আরও সাড়ে তিন হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও বিতরণ করা হয়েছে।’

এদিকে টানা বৃষ্টিতে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ, হাশিমপুর, বরমা, বরকল, জোয়ারা, ধোপাছড়ি, বৈলতলী ও দোহাজারীর অধিকাংশ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। টানা এক সপ্তাহ বন্যার পানিতে ভাসার পর গত রোববার রাত থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিছু কিছু গ্রামীণ সড়কের ওপর দিয়ে এখনও প্রবাহিত হচ্ছে বন্যার পানি। বন্যাকবলিত অসংখ্য মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

 

পুরো সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জাতীয় মহাসড়কের দক্ষিণ হাশিমপুর বড়পাড়া (কসাইপাড়া) অংশে বন্যার পানি প্রবাহিত হলেও গতকাল থেকে যানবাহন চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বন্যার পানিতে গ্রামীণ সড়ক ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে।

দোহাজারী সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার গাছবাড়িয়া-চন্দনাইশ-বরকল (শহীদ মুরিদুল আলম সড়ক) জেলা সড়কের সাতঘাটিয়া পুকুরপাড় থেকে বরকল ব্রিজ পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে গত দুইদিন ধরে চার ফুট পানির নিচে ডুবে আছে। এছাড়া পটিয়া-চন্দনাইশ-বৈলতলী জেলা মহাসড়কের নবম কিলোমিটার থেকে ১১তম কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ক তিনদিন ধরে তিন ফুট পানির নিচে ডুবে আছে। এ দুটি সড়কে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা।

 

চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম বদরুদ্দোজা বলেন, অবিরাম বর্ষণের ফলে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চন্দনাইশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার শতকরা ৮০ ভাগ লোক পানিবন্দি। এসব মানুষের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। স্ব-স্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে, বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৪৫ মেট্রিক টন চাল, মজুত রাখা হয়েছে আরও ১৫ মেট্রিক টন ত্রাণ।

গত ১০ দিনের ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধস ও বন্যার পানিতে ভেসে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- জঙ্গল খিরামের বাসিন্দা কালেন্দী রাণী চাকমা (৪০), জাফতনগর ইউনিয়নের নাসির উদ্দিনের ছেলে মহিউদ্দিন ইমতিয়াজ (২০) ও লেলাং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান।

 

স্থানীয় সূত্র জানায়, বৃষ্টি কমলেও প্লাবিত হচ্ছে উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। উপজেলার উত্তরাঞ্চল তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় ধীরে ধীরে পানি দক্ষিণাঞ্চলের দিকে নামতে শুরু করায় প্লাবিত হচ্ছে এসব এলাকা। উপজেলার দাঁতমারা, নারায়ণহাট, ভূজপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, সুন্দরপুর, কাঞ্চননগর, লেলাং, ধর্মপুর, বখতপুর, নানুপুর, জাফতনগর, রোসাগিংরী, সমিতিরহাট, আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নসহ ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। বন্যার পানিতে বীজতলাসহ বহু গ্রামীণ রাস্তাঘাট, মৎস্য খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাটবাজার ডুবে রয়েছে।

বোয়ালখালী উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক পূজন সেন জানান, ১০ দিনের টানা বর্ষণে পানিপ্রবাহ বেড়েছে কর্ণফুলী নদীতে। ঢল নেমেছে ভাণ্ডালজুড়ি খালে। এতে উপজেলার জ্যৈষ্ঠপুরার ভাণ্ডালজুড়ি খালে সাতটি বসতঘর তলিয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও ১০ পরিবারের বসতঘর। এছাড়া টানা বৃষ্টির ফলে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, ডুবেছে ফসলি জমি।

শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম বলেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ভাণ্ডালজুড়ি খালে এ পর্যন্ত সাতটি পরিবারের বসতঘর তলিয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও ১০টি পরিবারের বসতঘর। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে এবং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হচ্ছে। উপজেলার পাহাড়ি এলাকাতে দুর্ভোগে আছেন বাসিন্দারা।

 

পটিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, টানা বর্ষণে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বেশকিছু বসতঘর। পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ২০০ পুকুরের মাছ। প্লাবিত হয়েছে উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা, ভাটিখাইন, ছনহরা, ধলঘাট, হাবিলাসদ্বীপ, জিরি, কুসুমপুরা, আশিয়া, কোলাগাঁও ছাড়াও পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড। শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধের ভাটিখাইন, ছনহরা ও কচুয়াইসহ বেশ কয়েকটি স্পটে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করে তলিয়ে গেছে আউশের বীজতলা।

কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম ইনজামুল হক জসিম জানান, শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে এখন কচুয়াইয়ের পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে। এভাবে পানি জমে থাকলে বড় ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

রাউজানে ভারী বর্ষণে ডাবুয়া ও সর্তা খাল দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে ফসলি জমি ও সড়ক। পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ধানের বিস্তীর্ণ বীজতলা। পানিতে ডুবে আছে হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্তা, হলদিয়া, গর্জনিয়া, এয়াসিন নগর, জনিপাথর, বৃকবানপুর, ডাবুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ডাবুয়া, লাঠিছড়ি, কেউকদাইর, রামনাথপাড়া, পূর্ব ডাবুয়া, হাসান খীল ও দক্ষিণ হিংগলা, চিকদাইর ইউনিয়নের পাঠানপাড়া, দক্ষিণ সর্তা ও চিকদাইর, গহিরা ইউনিয়নের দলইনগর ও কোতয়ালী ঘোনা, নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের সড়ক ও জমি। হালদা নদী ও তেলপারই খাল দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে নদীমপুর ও পশ্চিম নদীমপুর এলাকার ফসলি জমি।

উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা এহেছান মুরাদ বলেন, ‘সর্তা ও ডাবুয়া খালের চার পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানির স্রোতের তীব্রতায় রাউজানের রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। দুর্গত মানুষের মাঝে এ পর্যন্ত দুইশ প্যাকেট শুকনা খাবার, ১৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ টাকা দেয়া হয়েছে। আরও সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতি প্রশাসনের রয়েছে।’ সূত্রঃ জাগো নিউজ

ad

পাঠকের মতামত