298428

ভুল করেছি কিন্তু টাকা ছাড়ব না

মীর্জা সিকান্দার আলীর ব্যবসার জমানো টাকা অতিরিক্ত লভ্যাংশের লোভ দেখিয়ে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম। ২০০৭ সালে তিনি ৫ লাখ টাকা দেন। ২০১৮ সালে লভ্যাংশ মিলে দ্বিগুণ দেয়ার কথা থাকলেও তা পাননি। উল্টো আরও ৫ লাখ টাকা লভ্যাংশের লোভের ফাঁদে ফেললেও তিনি আর বিনিয়োগ করেননি। এ বছর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর লভ্যাংশের জন্য ঘুরেও পাননি। লভ্যাংশ তো দূরে থাক আসলও পাচ্ছেন না সত্তরোর্ধ্ব মীর্জা সিকান্দার।

তিনি বলেন, ‘লভ্যাংশের লোভের ফাঁদে আজ আমার আসলও নেই। আজ আমার পথে বসার দশা। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর টাকাটা চেয়েছি, দেবে দেবে করেও দেয়নি। খিলগাঁও আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটিতে যোগাযোগ করেও কাউকে পাইনি। আমি বিচার চাই। আমার মতো বৃদ্ধের টাকা মেরে দেয়া জুলুম ছাড়া কিছুই নয়।’

এদিকে একইভাবে প্রতারণার শিকার সুফিয়া আক্তারের বংশাল থানায় দায়ের করা মামলায় গত ১০ জুলাই মতিঝিল এলাকা থেকে প্রধান আসামি এম তাজুল ইসলামকে (৬৯) গ্রেফতার করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।

রোববার সকাল থেকেই রাজধানীর মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে ভিড় করতে থাকেন আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির মাধ্যমে প্রতারিত অর্ধশতাধিক গ্রাহক। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রতারণার শিকার মীর্জা সিকান্দার আলী। অধিকাংশ গ্রাহকের বয়স ৫০ বছরের বেশি। শেষ বয়সে সবাই সম্বল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন জমার টাকা ও লভ্যাংশ। কিন্তু লভ্যাংশের সঙ্গে আসল টাকা নিয়েও দুশ্চিন্তায় বয়স্ক এসব গ্রাহক।

ফরিদ আহমেদ নামে আরেক গ্রাহক বলেন, ৭ বছর ধরে টাকা জমা রেখেছি মাসিক লভ্যাংশের আশায়। কিছু দিন টাকাও পেয়েছি। কিন্তু এরপর ঘুরাতে থাকে। গত বছর ডিপোজিটের মেয়াদ শেষ হয়। টাকা চাইতে গেলে তারা টাকা নগদে না দিয়ে চেক দেন। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে দেখি ওই চেকের বিপরীতে টাকা দেয়ার মতো টাকা নেয় তাদের অ্যাকাউন্টে। এরপর থেকে ঘুরছি তো ঘুরছি। কখনও তাটবাহানা করছে, তো কখনও হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আমরা কোথায় যাব? এ প্রতিষ্ঠানটি এমন জালিয়াতি করতে পারে ভাবিনি।’

আরেক গ্রাহক তার জমি বিক্রি করে ৩৫ লাখ টাকা আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির ইব্রাহিমপুর (মিরপুর) শাখায় ডিপোজিট করে এখন পথে বসার দশা। ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেমের কথা বলে মাসিক ও স্থায়ী আমানত হিসেবে এফবিআর করেন।

আব্দুল্লাহেল বাকি নামে ওই গ্রাহক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘২০১১ সালে টাকা দিয়েছি। এরপর ২০১৬ সালেও দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানটি লাপাত্তা। ইব্রাহিমপুর শাখা বন্ধ। ঘুরেও কোনো কর্মকর্তার সাক্ষাৎ পাই না। লাভের আশায় জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে আমার জীবনটাই ছন্নছাড়া। বউ বাচ্চা নিয়ে কোনো মতে চলে যাচ্ছে।’

একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম ভূঁইয়া। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পূর্বপরিচিত তাজুল ইসলামের মাধ্যমে পরিচয় হয় আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির সঙ্গে। তিনিই মাসিক ১৪ শতাংশ ও স্থায়ী আমানতের জন্য ১৮ শতাংশ লভ্যাংশের প্রলোভন দেখান। ফাঁদে পা দিয়ে নিজে ৩২ লাখ টাকা দেন তাজুল ইসলামের হাতে। এরপর লাভও নেই আসলও নেই।’

ফখরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা সবাই ভুলটা বুঝে গেছি। লভ্যাংশ তো দূরে আসলও মেরে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তাজুল সাহেবে। নামে বেনামে সম্পত্তি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন তার সব সম্পত্তি ক্রোক করে আমাদের সবার লভ্যাংশসহ আসল টাকা দিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করা হোক।’

বংশাল থানায় দায়ের করা মামলার বাদী সুফিয়া আক্তার বলেন, ‘যখন টাকা দিয়েছি তখন তো লভ্যাংশও দিয়েছে। সমবায় অধিদফতরের অনুমোদনও ছিল। এখন বুঝতেছি ওটা ব্যাংক ছিল না। অথচ সোসাইটি ব্যাংক মনে করে ১২ লাখ টাকা রেখেছিলাম। টাকা দিয়েছি এখন আমার পথে বসার দশা। অনেক চেষ্টা করছি টাকা উদ্ধারের। বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। মামলা করেছি। ওর শাস্তি হোক সেটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু তার আগে আমরা টাকাটা ফেরত চাই। টাকা আমরা কোনোভাবে ছাড়ব না।’

এর আগে রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ গ্রাহকের জমার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং শত কোটি টাকা কানাডায় পাচার করেছেন আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া সমবায় সমিতিকে ব্যাংক হিসেবে প্রচার করে লভ্যাংশের ফাঁদে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি। লভ্যাংশ তো দূরের কথা আসলই পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। কাডানায় থাকা দুই ছেলের নামে আত্মসাতের টাকা পাচার করেছেন তাজুল ইসলাম।’

গ্রাহকের জমার টাকা আত্মসাৎ এবং শত কোটি টাকা কানাডায় পাচারের অভিযোগে গত শুক্রবার (১২ জুলাই) ডিএমপির রমনা থানার একটি মামলা করেছে সিআইডি। মামলা নং- ২১। এ মামলায় তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রীসহ তাদের তিন সন্তানকে আসামি করা হয়েছে। একই ধারায় গত ২৫ মে বংশাল থানায় মামলার তদন্ত চলমান। মামলা নং-৪৩। বংশাল থানার মামলায় গত ১০ জুলাই মতিঝিল এলাকা থেকে প্রধান আসামি এম তাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।

আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির কার্যক্রম ১৯৮৪ সালে শুরু হয়। তাজুল ইসলাম ১৯৮৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট শাখার প্রধান ছিলেন। ২০০৫ সাল থেকে তিনি আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটিতে যুক্ত হয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাত শুরু করেন।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সারাদেশে ২৬টি শাখার অনুমোদন থাকলেও ১৬০টি শাখা পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ৮০টি শাখার ১১ হাজার ৪২৫ (৩০ জুন ২০১৬ পর্যন্ত) গ্রাহকের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা আমানত গ্রহণপূর্বক আত্মসাৎ করা হয়।

আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম ৮০টি শাখার ব্যবস্থাপক ও ২য় কর্মকর্তারা গ্রাহকদের অধিকহারে মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে নগদ আমানত সংগ্রহ করেন। জমা টাকার মেয়াদ পূর্তিতে গ্রাহকরা আসল টাকা ও লভ্যাংশ ফেরত চাইতে গেলে কালক্ষেপণ ও নানাভাবে টালবাহানা করে আসছিলেন।

ad

পাঠকের মতামত