290679

ইলমুদ্দীন : নবীপ্রেমে শাহাদাত আলিঙ্গনকারী এক কাঠমিস্ত্রী

পেশায় দক্ষ কাঠমিস্ত্রী হলেও তালেমন্দ ছিলেন সৎ মানুষ। সততার জন্যই লাহোরের মানুষ তাকে সম্মান করতো। ১৯০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর তার ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে ছেলেশিশু। তালেমন্দ ভাবলেন, নিজে অত ভালো ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে পারেননি। শুধু সরল বিশ্বাস খোদাভক্তি আর নবীপ্রেমে ভর করে যতটা পারেন ধর্মকর্ম করেন। এবার ছেলেকে ধর্মজ্ঞান দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। ছেলের নাম রাখলেন ইলমুদ্দীন, যার অর্থ হলো ধর্মের জ্ঞান।

সেসময়কার মুসলিম শিশুরা মসজিদ থেকেই জ্ঞানার্জন করতো। তালেমন্দ তার ছেলেকে কুরআন শেখার জন্য মসজিদে পাঠালেন। ইলমুদ্দীন কিছুদিন সেখানে যাতায়াত করে ঠিকই, কিন্তু বিদ্যা অর্জন করা আর তার নসিবে জোটে না। আল্লাহ হয়তো গতানুগতিকতার বাইরে ধর্মের অন্য কোনও মিশনের জন্য প্রস্তুত করছিলো তাকে। ইলমুদ্দীনের ভাই মুহাম্মাদুদ্দীন সৌভাগ্যবশত সরকারি চাকরি লাভ করেন। অন্যদিকে ইলমুদ্দীন বাবার হাত ধরে কাঠমিস্ত্রীর পেশায় আত্মনিয়োগ করে। বাবার মতো সেও একজন ভালো কাঠমিস্ত্রী হয়। কাজের প্রয়োজনে বাবার সাথে বিভিন্ন সময়ে লাহোরের বাইরেও গমন করতো ইলমুদ্দীন।

ইলমুদ্দীন না কখনও হজ-ওমরাহ করেছে, না কখনও কোনও শায়খের সাথে সম্পর্ক গড়ে দীর্ঘ আমল করেছে। দ্বীনি বিষয়ে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যই সে অর্জন করেনি। তার তো সম্বল ছিলো শুধু এক কালমা। এই কালমাকে সে ভালোবাসতো। কালমা থেকে দুই মহান সত্তাকে অনুভব করতো সে- আল্লাহ এবং তার রাসুল (দ)।

ইলমুদ্দীন এক সাদাসিধে মুসলমান। দিনরাত নিজের পেশায় ডুবে থাকতো সে। রাজপালের ঘৃণ্য উদ্যোগে সারা হিন্দুস্তান যে উত্তাল— এর বিন্দুমাত্র খোঁজও তার ছিলো না। একদিন সন্ধ্যেবেলায় কাজ শেষ করে ইলমুদ্দীন ঘরে ফিরছিলো। দিল্লি গেটের কাছে এলে সেখানে এক বিশাল সমাবেশ দেখতে পায়। ডায়াস থেকে এক নওজোয়ানের অগ্নিঝরা বক্তৃতার আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে। কিন্তু মাতৃভাষা পাঞ্জাবি হওয়ায় উর্দু ভাষণ সে খুব বেশি বুঝতে পারে না। উর্দু ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা। তার তো আর প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের সুযোগ হয়নি। পাশের এক ব্যক্তিকে অবস্থা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, রাজপাল নামের এক প্রকাশক রাসুলুল্লাহর (দ) শানে গোস্তাখি করে বই প্রকাশ করেছে। তার প্রতিবাদে আজকের এ সমাবেশ।

কিছুক্ষণ পর মঞ্চে আসেন একজন পাঞ্জাবি বক্তা। ইলমুদ্দীন খুব মনোযোগের সাথে তার আলোচনা শোনে। ইলমুদ্দীনের মানসজগতে নবীপ্রেমের ঝড় ওঠে। রাজপালের এই দুঃসাহসিকতা ইলমুদ্দীনের হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। সমাবেশ শেষ করে মধ্যরাতে সে ঘরে ফেরে। বাবা জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার? আজ হঠাৎ দেরী কেনো? ইলমুদ্দীন সব খুলে বলে। তালেমন্দও একেবারে সাদাসিধে মুসলমান ছিলেন। সব শুনে তিনিও ক্ষুব্ধ হন। বলেন, এমন বদমাশকে জাহান্নামেই পৌঁছানো উচিত।

ইলমুদ্দীন স্বপ্নে দেখে, এক বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, ‘ইলমুদ্দিন, এখনও ঘুমিয়ে আছো! দুশমন তোমার নবীর শানের খেলাফে লিপ্ত। ওঠো। জলদি করো।’ ইলমুদ্দিনের ঘুম ভেঙে যায়। উত্তেজনায় তার সারা শরীর ঘেমে ভিজে যায়। সে অস্থির হয়ে পড়ে। সে রাতে ইলমুদ্দীনের আর ঘুম হয় না। পরবর্তী দিন সে তার বন্ধু শেদার সাথে দেখা করে। তাকে সব খুলে বলে।

ইলমুদ্দীন যে স্বপ্ন দেখেছে, হুবহু একই স্বপ্ন শেদাও দেখে। স্বপ্নে দেখা বুযুর্গ উভয়কে একই আদেশ দিয়েছেন। তারা উভয়েই পেরেশান। কে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। উভয়ই এই গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে সম্পন্ন করতে চাইলো। আখের আলোচনার মাধ্যমে কোনো ফায়সালা করতে না পেরে তারা লটারি করে। লটারিতে ইলমুদ্দীনের নাম ওঠে। শেদার অনুরোধে পুনরায় লটারি করা হয়। এবারও ইলমুদ্দীনের নাম ওঠে। শেদার পীড়াপীড়িতে তৃতীয়বার লটারি করলে এবারও ইলমুদ্দীনের নাম ওঠে।

সেই দিনগুলোতে পুরো হিন্দুস্তানে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার, সর্বত্রই চলছিলো রাজপালের স্পর্ধা নিয়ে আলোচনা। ইলমুদ্দীন আর শেদা অনেক খুঁজে জানতে পারে না যে, কে এই নরাধম রাজপাল; কোথায় তার দোকান; সে দেখতেই বা কেমন। পরিশেষে শেদার এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, নরাধম রাজপালের লাইব্রেরি হাসপাতাল রোডে।

এদিকে ইলমুদ্দীনের অনিয়মানুবর্তিতার বিষয়টি তালেমন্দকে অনেক ভাবায়। ছেলের অবস্থার পরিবর্তন না দেখে তালেমন্দ সিদ্ধান্ত নেন, বিশ বছর বয়সী ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেবেন। সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে, অপ্রত্যাশিত অবস্থাও শুধরে যাবে। তারা পাত্রী দেখে ইলমুদ্দিনের বিয়ের কথাবার্তা পাকাপোক্ত করে ফেলেন।

৬ এপ্রিল, ১৯২৯। ইলমুদ্দীন সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়। গুমটি বাজারের দিকে যায়। আত্মারাম কামারের দোকানে গিয়ে সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো একটি ছুরি কেনে। দ্রুত হাসপাতাল রোডে পৌঁছে। আনারকলি হাসপাতাল রোডে ইশরত পাবলিশিং হাউজের সামনেই রাজপালের অফিস। সেখানে পৌঁছে ইলমুদ্দীন জানতে পারে, রাজপাল এখনও আসেনি। অপেক্ষায় থাকে। ইতোমধ্যে রাজপালের অফিসের সামনে এসে একটি কার থামে। ইলমুদ্দীন জানতে পারে, কার থেকে যে লোকটা নামছে, সেই রাজপাল। এই নরাধমই রাসুলের (দ) শানে গোস্তাখি করে বই প্রকাশ করেছে এবং তা নামমাত্র মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে।

রাজপাল গাড়ি থেকে নেমে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে নিরাপত্তা দানকারী পুলিশকে তার আসার কথা জানানোর জন্য টেলিফোন উঠানোর কথা ভাবছে— এমন সময় ইলমুদ্দীন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সেসময়ে অফিসে দু’জন কর্মচারী ছিলো। কুদারনাথ পেছনের কামরায় বইপত্র রাখছিলো আর ভগতরাম রাজপালের পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। ইলমুদ্দীন ভেতরে প্রবেশ করে চোখের পলক পড়ার আগেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে। হাতটা উঁচুতে উঠে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো ছুরির আঘাত রাজপালের বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়।

ইলমুদ্দীন দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে গা ঢাকা দেয়। দোকানের দুই কর্মচারী বাইরে এসে চিৎকার করতে থাকে, ‘ধরো! ধরো! … মেরে ফেলেছে! মেরে ফেলেছে!’ কাশ্মির থেকে রাসকুমারি পর্যন্ত চারিদিকে দাবানলের মতো গাজী ইলমুদ্দীনের বাহাদুরির কথা ছড়িয়ে যায়। নবীপ্রেমের নজরানা পেশ করার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ইলমুদ্দীন।

১০ এপ্রিল, ১৯২৯ তারিখে ইলমুদ্দীনকে সর্বপ্রথম আদালতে ওঠানো হয়। ইলমুদ্দীনের পক্ষে এক ঝাঁক মুসলিম উকিল সাড়া দেন। ব্যারিস্টার খাজা ফিরোজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন এবং তাদের সহযোগিতায় ডা. এ আর খালেদ, মাস্টার সেলিমসহ কয়েকজন ইলমিদ্দীনের পক্ষে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। উকিলরা অসংখ্য দলিল ও আইনের ধারা পেশ করেন। কিন্তু ৯ মে, ১৯২৯ তারিখে ইলমুদ্দীনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।

ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন মুম্বাই গিয়ে ব্যারিস্টার (পরবর্তীতে কায়েদে আজম) মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইলমুদ্দীনের পক্ষে লাহোর হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন জিন্নাহ। যথাসময়ে শুনানি হয়। জিন্নাহ আদালতে বলেন, ‘ইওর অনার! ইসলামের নবী রাসুলুল্লাহর (দ) শানে গোস্তাখি করা এবং জনসাধারণের মধ্যে দ্রোহের আগুন উসকে দেয়া ১৩৫ ধারার আলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আইনের নিস্তব্ধতাই ইলমুদ্দীনকে আইন নিজ হাতে তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। এজন্য ইলমুদ্দীনের অপরাধকে ৩০২ ধারায় হত্যা হিসেবে গণ্য না করে ৩০৮ ধারায় এজিটেশন কিলিং গণ্য করা উচিত, যার শাস্তি বেশি থেকে বেশি সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। তাছাড়া ইলমুদ্দীনের যে বয়স, তাতে সে মৃত্যুদণ্ডের আইনের আওতাভুক্তও নয়।’

লাহোর হাইকোর্টের কট্টর হিন্দু বিচারপতি শাদিলাল কোনও কথায় কর্ণপাত না করে আপিল খারিজ করে দেন। এরপর ফাঁসির জন্য ইলমুদ্দীনকে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩১ অক্টোবর, ১৯২৯ তারিখে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র ২১ বছর বয়সী অতি সাধারণ মুসলিম কাঠমিস্ত্রী রাসুলের (দ) মহব্বতে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে।

ফাঁসি কার্যকর করার পর সেখানেই জানাযা ছাড়া ইলমুদ্দীনকে দাফন করা হয়। এদিকে তার শাহাদাতের খবর দাবানলের মতো সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের লাশ তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরে দাফন করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমানরা আল্লামা ইকবালের নেতৃত্বে বরকত আলী মোহামেডান হলে সমাবেশ ঘোষণা করে। ১ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের বাসভবনে জলসা সংঘটিত হয়। ২ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের দাবিতে প্রোফেশনাল মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ফিরিঙ্গি সরকারের থেকে শহীদের লাশ আদায়ের ব্যাপারে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়। ৫ নভেম্বর আল্লামা ইকবাল, স্যার মুহাম্মাদ শফি, মিয়াঁ আব্দুল আজিজ, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গভর্নরের সাথে দেখা করে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে শহীদের লাশ সমর্পণের জন্য আবেদন করেন।

অবশেষে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার শাহাদাতের ১৪ দিন পর মুসলমানদের কাছে শহীদের লাশ অর্পণ করে। শহীদের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ট্রেনে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪ নভেম্বর, ১৯২৯ তারিখে শহীদ ইলমুদ্দীনের পবিত্র লাশকে তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরের ভাওয়ালপুর রোডের নিকটস্থ মিয়ানি সাহেব কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুসারে, ইলমুদ্দিনের জানাযায় ছয় লাখ মুসলমান অংশগ্রহণ করে। লাহোরের ভাটিচক থেকে শুরু করে সুমনাবাদ পর্যন্ত পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জানাযা শেষে আল্লামা ইকবাল এবং শিয়া মাওলানা সাইয়্যেদ দিদার আলী শাহ নিজ হাতে শহীদের লাশ কবরে রাখেন। যখন তার লাশ কবরে রাখা হচ্ছিলো, তখন সুন্নি মাওলানা জাফর আলী খান চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘হায়! আজ এই মর্যাদা যদি আমার নসিবে জুটতো!’ ঠিক সেই মুহূর্তেই আল্লামা ইকবালের জবান থেকে উচ্চারিত হয়—

اسی گلاں ای کر دے رہ گئے تے تر خاناں دامنڈابازی لے گیا  আমরা পরিকল্পনাই বানাতে থাকি আর এক কাঠমিস্ত্রির ছেলে এসে মর্যাদা লুফে নিয়ে যায়।

ad

পাঠকের মতামত