289903

‘আঁর মাইয়ার সাহস য্যান হারা দেশে ছড়াই যায়’

নিউজ ডেস্ক।। ‘আঁর কইলজাটা যেগুনে কাড়ি নিছে হেগুনের কঠিন শাস্তি চাই। আঁর মাইয়্যা শেষ নিষ (নিঃশ্বাস) হর্যন্ত লইড়ছে। অন আঁর মাইয়্যার লাই হারা দেশে বেকে কান্দে, বেকে রাস্তাত নাইমছে। আঁই চাই সবাই য্যান রাস্তাততুন না সরে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাই যেন রাস্তাত থাকে। আঁর মাইয়্যা যে সাহস ও প্রতিবাদ দেখাইছে হে সাহস য্যান হারা দেশে ছড়াই যায়।’ ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় প্রতিবাদী কণ্ঠে এই কথাগুলো বললেন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারানো সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আক্তার। শুক্রবার তার সঙ্গে কথা হয় উপজেলার চর চান্দিয়া গ্রামের বাড়িতেই।

বাড়িতে প্রবেশের লম্বা রাস্তা পেরোতেই চোখে পড়ে নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে বেশকিছু ব্যানার। ভিড় মাড়িয়ে উঠানে পা রাখতেই ঘর থেকে বিলাপের শব্দ কানে আসে। নুসরাতের মায়ের আহাজারিতে স্বজনের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। বোনের শোকে ছোট ভাই রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যারা সান্ত্বনা দিতে এসেছেন তারাও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। নুসরাতের পড়ার ঘরে বসেই মা বিলাপ করছিলেন। আর মেয়ের শেষ স্মৃতি বই-খাতা-কলম বারবার বুকে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন। রুমে হার্ডবোর্ডের দেয়ালে নুসরাতের লিখে যাওয়া লেখাগুলো সবাইকে দেখাচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে শিরিন আক্তার জানান, তাকে নিয়েই ছিল নুসরাতের যত আহদ্মাদ। ছোটবেলা থেকেই মাকে ছাড়া তিনি ঘুমাতেন না। মাকে নিয়ে দেয়ালে অনেক কিছু লিখেছেন। সুন্দর সুন্দর বাণী লিখে রাখতেন। ছোটবেলা থেকেই বেশ সাহসী ছিলেন নুসরাত।

একটু কান্না থামিয়ে ২৭ মার্চ শ্নীলতাহানির ঘটনার পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করেন শিরিন আক্তার। পুরো কথাই তিনি ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় বলেন। পাঠকের সুবিধার্থে সেগুলো প্রমিত বাংলায় উপস্থাপন করা হলো। মা বলেন, ঘটনা শুনেই আমি মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অধ্যক্ষ হাত-পা ছেড়ে বসে আছেন। মেয়েকে শ্নীলতাহানির বিষয়ে প্রশ্ন করার পর তিনি আমাকে রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের ভয় দেখান। আমি ভীত না হয়ে সামনে পাওয়া একটি বেত দিয়ে অধ্যক্ষকে কয়েকবার বেত্রাঘাত করি। এ অবস্থা দেখে অনেকেই জড়ো হয়ে যান। সেখানে বসেই আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছি। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বিষয়টি চেপে যেতে বলেন।

তিনি বলেন, অনেক আগে থেকেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের অপকর্মের কথা শুনে এসেছি। আমরা আলিম পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নুসরাতকে অন্য মাদ্রাসায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছি। তার আগেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নুসরাত চিরবিদায় নিল।  ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নুসরাতের মা বলেন, কোনো হুমকিতে আমরা দমিনি। আমার মেয়ে বলেছে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। মেয়েটি নিজের জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নয়; বরং আমাদের মেয়ে সমাজকে পরবর্তী হিংস্রতা থেকে বাঁচাতে গিয়েই জীবন দিয়েছে। নুসরাতের এই আগুন, এই সাহস, ছড়িয়ে পড়ূক সবখানে।

তিনি বলেন, আমার মেয়ের হত্যার বিচারের দাবিতে সারাদেশের মানুষ যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন এ জন্য আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে তারা যেন এই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। কেউ যেন প্রতিবাদ থেকে সরে না যান। বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই প্রতিবাদ অব্যাহত থাকুক। আমি চাই আমার মেয়ের মতো সারাদেশের অন্য মেয়ে এবং মায়েরা এমন প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকা রাখুক। সবাই সাহসী হয়ে উঠুক। সবাই জাগলে সমাজের নির্যাতন বন্ধ হবে, সমাজটা পরিবর্তন হবে। সবাই যদি তাদের কণ্ঠস্বরটা জোরালো করে তাহলে নুসরাতের মতো আর কাউকে প্রাণ দিতে হবে না। আমরা চাই আমার মেয়ের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সমাজ থেকে এমন বর্বরতা বন্ধ হোক, তাহলেই আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে। মায়ের কথায় সায় দিয়ে নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদ হাসান নোমান বলেন, নুসরাত এখন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম, প্রেরণার নাম, সাহসের নাম।

হিংস্রতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দেওয়া নুসরাতের জন্য কাঁদছে প্রতিবেশীরাও। নুসরাতকে যেখানে কবর দেওয়া হয় সেখানে গিয়ে দেখা গেল নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নুসরাতের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। কবরের পাশেই মসজিদ। মসজিদে নুসরাতের জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়। জুমার নামাজ শেষে এলাকাবাসী ছুটে যান কবরে। সবাই একসঙ্গে কবর জিয়ারত করেন। এ সময় নুসরাতের বাবা একেএম মুসা মানিক ও দুই ভাইয়ের আহাজারিতে কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। স্থানীয়রা তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, নুসরাত প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। নুসরাত আমাদের সবাইকে পথ দেখিয়ে গেছে, অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে। নুসরাত এখন আমাদের অনুপ্রেরণা।

ফেনীর সমাজকর্মী মঞ্জিলা মিমি বলেন, সামাজিকভাবে নানা চাপ ও ভয়ভীতি সত্ত্বেও মেয়েটি আপস করেনি, সে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। হাসপাতালে শুয়ে থেকেও সে লড়াই করার মনোভাব দেখিয়েছে। ঘটনাটি কষ্টকর, মর্মান্তিক হলেও সে মানুষকে সচেতন করে দিয়ে গেছে, তাদের ভেতরের বিবেক জাগিয়ে তুলেছে, নাড়া দিয়ে গেছে। নুসরাত হত্যার বিচার নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েটি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত