263465

বিবিসিকে যা বললেন জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে সমালোচিত রাজনৈতিক দল জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। পদত্যাগ বিষয়ে জামায়াতের এই নেতা শনিবার সন্ধ্যায় কথা বলেন বিবিসির বিশেষ ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মাসুদ হাসান খান।বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, বর্তমানে জামায়াতের রাজনীতি অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে আছে। জামায়াতের এই চরম অবস্থার মধ্যে আপনি দল থেকে কেন পদত্যাগ করলেন?

এর উত্তরে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘দীর্ঘ ৩০ বছর আমি জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। দুটো অঙ্গনে বেশি কাজ করেছি। একটি হচ্ছে আইন ও অন্যটি কূটনৈতিক অঙ্গন। ১৯৯২ সালে গোলাম আজমের যে নাগরিকত্ব মামলা হলো, সেই মামলায় আমি জুনিয়র আইনজীবী ছিলাম। তারপরে সাঈদী সাহেবের মামলায় লড়েছি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ইমার্জেন্সির সময়ে নিজামী সাহেব ও মুজাহিদ সাহেবের মামলা লড়েছিলাম প্রধান কৌঁসুলি হয়ে।

২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ৩ থেকে ৪ বছর আমি প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে শীর্ষ ১০ জন জামায়াত নেতার মামলা পরিচালনা করেছি। সুতরাং আমার যেটা কাজ ছিল জামায়াতকে লিগ্যালি রিফর্ম করা, সেটা আমি সততার সাথে পালন করেছি। আমি কিছু ডিপ্লোমেটিক কাজও করেছি। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারেই ইউনাইটেড স্টেটসে, ইউনাইটেড নেশন্সে, ফ্রান্স, জার্মানিতে আমি অনেক ডিপ্লোমেটিক কাজ করেছি। এছাড়া আমি বলেছি, আমার পদত্যাগপত্রে ৩০ বছর আগে আমি যখন জয়েন করি, তখন জয়েন করার পরে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি জামায়াতকে রিফর্ম করব। সেই রিফর্ম করতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।

আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, আজকে জামায়াত কেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন? আজকে জামায়াতকে কেন একটি গ্লানি বহন করতে হচ্ছে ? ৭১ সালে যে শিশু জন্ম নিয়েছে, সে তো ৭১-এর যুদ্ধ দেখেনি। সে তো সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। কিন্তু আজকেও তাকে এর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। এমনকি ৮১তেও যে জন্ম নিয়েছে তাকেও এর দায়ভার নিতে হচ্ছে। এরা কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে অংশগ্রহণকারী অংশ হতে পারতো। আপনারা দেখেছেন, আমার পদত্যাগ পত্রে আমি আইটেমাইজড করে বলেছি, ২০০১ থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত আম কী করেছি। জামায়াতকে রিফর্ম করার জন্য, জামায়াতকে যেন ৭১-এর বোঝা বহন করতে না হয়, সে জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমি যখন দেখলাম, আমার আর কিছু করার নেই, কিছু দেওয়ার নেই, তখন আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিবিসি: আপনি আপনার পদত্যাগ পত্রে লিখেছেন যে, ৭১-এর যুদ্ধে ভূমিকার জন্য জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই কথাটা আপনি বুঝেছেন কিন্তু অন্যরা কেন বুঝছেন না? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: এই বিষয়টি আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। উদাহরণ দেখিয়েছি যে, স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দেশে কোনো দল নেতৃত্ব দিতে পারে না। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেখানে ওপিনিয়ন ডিভাইডেড ছিল। সবাই যে বিরোধিতা করেছে, তাই না। কিছু লোক পক্ষে ছিল আর কিছু লোক বিপক্ষে ছিল। জামায়াতের একটা সংস্কৃতি আছে, সেটা হলো জামায়াত পার্টি ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করে। ৫০ জনের মিটিংয়ে ২৬ জন যদি বলে আমরা এটার পক্ষে নয়, তাহলে বাকিদের বাধ্য হয়েই সেই ২৬ জনের মত মেনে নিতে হবে। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের কারণেই জামায়াত এখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কিন্তু একটা কথা আমি বলব…

বিবিসি: তার মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জামায়াত নেতাকর্মীরা আপনার সঙ্গে নেই ? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: দেখুন আমি জামায়াত নেতাদের আগেই বলেছি যে, দেখুন সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাই হোক না কেন, আপনারা লিডারশিপ দিচ্ছেন , আমরা লিডারশিপ দিচ্ছি (যদিও আমি এখন লিডারশিপে জড়িত নয়)। আমি নেলসন ম্যান্ডেলার উদাহরণ দিয়েছিলাম যে, শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে তিনি শেষপর্যন্ত আপসে গেলেন কিন্তু তার দলের লোক বলছিল যে, আমরা যুদ্ধ করব। সুতরাং এটা আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সবাই যে বোঝেন না, তা না। কিন্তু এটা তারা করতে অপারগ, যে কারণে আমি তাদের ব্যর্থ বলি।

বিসিসি: আপনি কি চাইছেন ৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াতকেই বিলুপ্তি করা হোক? কারণ তার একটা ৭১-এর স্টিগমা তো আছেই। ব্যারিস্টার রাজ্জাক: ৭১-এর স্টিগমা তো আছেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ২০১১ সাল থেকে এই দলের কার্যক্রম বস্তুত বন্ধ। বাংলাদেশের ৬৫টি ডিস্ট্রিক্টে যত অফিস আছে, প্রায় সবকটা অফিসই বন্ধ। ঢাকা শহরের ২-৩ টা অফিস, সবই বন্ধ। জামায়াতের নিবন্ধন নেই , জামায়াতের ইলেকশন সিম্বল নেই । সুতরাং এতে করে জামায়াত কোনো মিছিল করতে পারে না, মিটিং করতে পারে না। প্রেস কনফারেন্স সরকার যেহেতু করতে দিচ্ছে না, তাই জামায়াতের নতুন পরিকল্পনা করা উচিত।

বিবিসি: অর্থাৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে এখন মৃত বলবেন আপনি? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: জামায়াতকে কোনোভাবেই সরকার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ফাংশন করতে দিচ্ছে না যদিও আইনত জামায়াত এখনো বেইআইনি না। কিন্তু কার্যত সরকার এটাকে বে-আইনি করেই রেখেছে।

বিবিসি: তাহলে কি এটা বলা যে আপনিও চাপের মুখে এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন,পদত্যাগ করছেন, নতুন দল গড়বেন, জামায়াত বিলুপ্তি করতে হবে। আপনার ওপরে কি তাহলে কোনো চাপ আছে? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: একেবারেই না। চাপে হলে কি আমি ২০০১ সালে এই প্রশ্নটা উত্থাপন করতাম ? আজকে আমি যেটা মনে করি, জামায়াতের জন্য একিলিস হিল হচ্ছে ১৯৭১। জামায়াত তার ইতিহাসের মধ্যে ২০০১ সালে সবচাইতে ভালো অবস্থায় ছিল । জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল; দুইজনেই মন্ত্রিসভায় ছিল। একজন নির্বাচিত এমপি ছিল আর আরেকজন ছিল ফ্রম আদার কোটা । সুতরাং ওই সময়ে আমি উত্থাপন করেছিলাম যে, জামায়াতের দেশের কাছে মাফ চাওয়া উচিত। সুতরাং আমি কোনো চাপের মধ্যে কোনো কাজ করিনি ।

বিবিসি: ধরুন আপনি এখনো জামায়াতের রাজনীতির মধ্যে আছেন এবং আপনি দলের শীর্ষনেতা এবং দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত আপনার পক্ষে। তখন জাতির কাছে যখন ক্ষমা চাইতে বললে, আপনি আসলে কী বলতেন? জামায়াতের কী বলা উচিত? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমি এটা পরিষ্কার বলতাম যে, কারণ যাই হোক না কেন, আমরা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছি। এটা আমাদের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। কোনো দ্বিধা ছাড়াই আমি এটা বলতাম।

বিবিসি: মানে আপনি যখন বলবেন ১৯৭১ সাল আমি ভুল করেছি , আমরা ভুল করেছি , মাফ করে দিন তার মধ্য দিয়ে জামায়াতের একটা বিশাল অংশের রাজনীতিকে আমি নেগলেক্ট করে দিচ্ছেন, মানে হাউ হেলদি ইজ ইট? মানে জামায়াতের ভেতরে যারা আছে, যারা আপনার পক্ষে না। যারা আপনার মতের সঙ্গে সমর্থন করছে না, তারা তো এটা এভাবে দেখতেই পারে যে, রাজনীতির একটা বিশাল অংশকে আপনি উড়িয়ে দিচ্ছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমরা একটা পরিবর্তনের দুনিয়ায় বাস করি। ১৯৪০ সালের জামায়াত, ১৯৪৭ সালের জামায়াত, ১৯৭১-এর জামায়াত এবং একবিংশ শতাব্দীর জামায়াত এক হতে পারে না। আপনাকে স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করতে হবে। আমরা তুরস্কে দেখছি, সে কৌশল পরিবর্তন হয়েছে, তিউনিসিয়ায়ও দেখেছি।

বিবিসি: কিন্তু তুরস্ক বা তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো তো স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল না, জেনোসাইডের অভিযোগ ছিল না। তাহলে সেটার সঙ্গে এটাকে কীভাবে মেলাবেন? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: না ছিল না। সে জন্যই আমি বলছি, একটা রাজনৈতিক দল পেছনের দিকে তাকিয়ে যদি দেখে, আমরা ভুল করেছি, তাহলে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে কোনো সংকোচ থাকা উচিত না।

ফেসবুক লাইভে মোহাম্মদ এমদাদ নামে এক দর্শকের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কি অন্য কোনো দলে যোগদান করছেন?’ জবাবে রাজ্জাক বলেন, ‘আমি বলেছি আমার পেশায় ফিরে যাব এবং আমি একজন নাগরিক হিসেবে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমার যে কন্ট্রিবিউশান আছে, সেটাই করব।’

বিবিসি: সেটা কি দলের অধীনে করবেন? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: সেটা করার জন্য কোনো দলে যোগ দেওয়া ইজ নট অ্যাসেনসিয়াল। বিবিসি: আপনার সঙ্গে কি কোনো দলের কথাবার্তা হয়েছে? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: নিশ্চয় না। একেবারেই না। কিন্তু আমি মনে করি দেশ ও জাতির জন্য আমার কিছুটা কন্ট্রিবিউট করার আছে। এ সময় আনাস নামে অন্য একজন জানতে চান, ‘জামায়াত থেকে আর কারও পদত্যাগের সম্ভাবনা আছে কি না বা আপনার সঙ্গে এমন কারও যোগাযোগ আছে কি না?’ জবাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘সেই সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই, কোনো বক্তব্য নেই। আমি নিজস্ব চিন্তাভাবনায়, বিবেকবুদ্ধিতে পদত্যাগ করেছি।

বিবিসি: নতুন দল তৈরি করবেন কি? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমি বলছি না আমি একটা নতুন দল তৈরি করব? কিন্তু সিভিল সোসাইটিতে থেকেও দেশ ও জাতির জন্য খেদমত করা যায়। দল করা তো জরুরি না। বিবিসি: কিন্তু রাজনীতি করার জন্য তো দল জরুরি। ব্যারিস্টার রাজ্জাক: হ্যাঁ, তা জরুরি কিন্তু দেশের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

বিবিসি: তার মানে মাঝে আমরা যে কথা শুনতে পাচ্ছিলাম যে, জামায়াতের মাঝে পরিবর্তন হবে, জামায়াত একটা সামাজিক অর্গানাইজেশন হিসেবে দাঁড়াবে। তার মানে ব্যাপারটা আপনিও সেদিকেই যাচ্ছেন যে, রাজনীতি সরাসরি বাদ। সামাজিক সংগঠন বা এমন কিছু করে একটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমি আজকে পদত্যাগ করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। সুতরাং প্রশ্নটা সে সময়ের জন্যেই রেখে দিন। ভাবনা নিশ্চয়ই আছে।

বিবিসি: জামায়াতকেই যদি বিলুপ্ত করা হয়, তবে ইসলামি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার জন্যে যারা জামায়াতের ছায়াতলে থেকে আন্দোলন করেছেন, তারা এখন কী করবেন? তাদের সামনে কী করার আছে? ব্যারিস্টার রাজ্জাক: বিশেষ করে যুবক সমাজকে আমি যে কথা বলব, ইসলামি রাষ্ট্রের যে কনসেপ্টটা ছিল, সেটা সম্পর্কে একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ দুনিয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং যে ইসলামি কনসেপ্ট ছিল, পাশাপাশি যে সমস্ত নতুন কনসেপ্ট এসেছে, সেটার দিকে যুবসমাজের গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। অ্যাজ এ মুসলিম ডেমোক্রেট। বাংলাদেশে একটি সেক্যুলার সংবিধান আছে। একটা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আছে। এর অধীনে সাম্য ও ন্যায়বিচারের অধীনে কীভাবে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন করা যায়, সেটাই চিন্তা করা উচিত।

ad

পাঠকের মতামত