192147

সৌদির গণমাধ্যমে কুড়িগ্রামের স্বপ্না রাণীর সাফল্যের গল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছেন ৩২ বছরের স্বপ্না রাণী। ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি এ সাহসী নারী থমকে যাননি। বাল্য বিয়ের শিকার স্বপ্না রাণীর স্বামী বিয়ের কিছুদিন পর নিখোঁজ হন। দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়া এই নারীর কাঁধে চাপে সংসারের গুরুদায়িত্ব। হাতে তুলে নেন অটোরিকশা। হয়ে উঠেন সংসারের চালক।

জীবনযুদ্ধে জয়ী স্বপ্নার চালক হয়ে ওঠা চড়াই-উতড়াইকে সমাজের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরেছে সৌদি আরবের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক আরব নিউজ। এক প্রতিবেদনে সৌদি এই গণমাধ্যম স্বপ্না রাণীর কষ্টজয়ী জীবনযুদ্ধের গল্প তুলে ধরেছে।

স্বপ্না রাণী আরব নিউজকে বলেন, ‘এমন সময়ও গেছে যখন আমি সন্তানদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে পারি নাই। বছরের পর বছর ধরে কোনো নতুন জামা-কাপড় পাইনি। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজন হয় না।’

দুই সন্তানের মা স্বপ্না রাণী একেবারে অল্প বয়সে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরপরই তার স্বামী রতন বর্মন নিখোঁজ হয়ে যায়। এখন ১৩ বছর বয়সী মেয়ে রাধা রাণী ও ১১ বছরের ছেলে হৃদয় চন্দ্র বর্মনকে নিয়েই তার সংসার।

‘যদিও এটা খুব কঠিন ছিল, তারপরও আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম যে, একদিন দারিদ্রের কষাঘাত থেকে বেরিয়ে আসবো। দুই বছর পর একটি সুযোগ পাই, ওই সময় আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল হক গ্রামের নারীদের অটোরিকশা চালানোর প্রস্তাব দেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাবে সাড়া দেই এবং বর্তমানে আমার মাসিক আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা।’

‘নারী চালক হওয়ায় প্রথমদিকে মানুষ আমার তিন চাকার এই অটোরিকশায় বসতে চায়নি। তারা দুর্ঘটনার শঙ্কা করতো। ভাবতো আমি ঠিকভাবে অটোরিকশা চালাতে পারবো না। আমি তাদের আশ্বস্ত করতাম যে, আমার অটোরিকশায় নিরাপদ ও আরামদায়ক সেবা পাবেন। কিছুদিন পর স্থানীয়রা আমার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেন। এখন সব যাত্রীই আমার অটোরিকশা চালানো উপভোগ করেন।’

সন্তানদের স্কুলের ব্যয় মাসিক তিন হাজার টাকা; এর পুরোটাই আসে তার আয় থেকে। সন্তানরাও তাকে নিয়ে গর্বিত যে, নারী সম্প্রদায়ের রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন তাদের মা। রাধা বলেন, ‘আমার মা অসাধারণ কিছু করতে শুরু করেছেন। যা অন্য নারীরা তার অাগে কল্পনাও করতে পারেনি।’

‘এখন তিনি আমাদের ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থা করছেন। দুই বছর আগেও যা ছিল অকল্পনীয়।’ স্বপ্না রাণীর ৭০ বছর বয়সী মা সাবিত্রি রাণী বলেন, তার মেয়ে সমাজের অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। তার অদম্য প্রচেষ্টা আমাদের নতুন পরিচয় ও ভালো আয়ের ব্যবস্থা করেছে।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি এমন এক প্রশ্নের জবাবে স্বপ্না রাণী বলেন, ‘আমার পরবর্তী পরিকল্পনা হচ্ছে একটি পিক-আপ ভ্যান কেনা। বর্তমানে রাস্তায় অসংখ্য অটোরিকশা। পিক-আপ ভ্যান হলে আমার আয় বাড়বে এবং তখন আমি একজন নারী সহকারী নিয়োগ দেবো।’

চেয়ারম্যান আমিনুল হক বলেন, ‘স্বপ্না আমাদের এলাকার আদর্শে পরিণত হয়েছেন। তার সফলতায় অন্যরা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এখন অনেক নারী তাদের বাড়ির বাইরে এসে আয় করতে এবং এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়।’

তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা মনে করতাম, স্বপ্নার অটোরিকশার যাত্রী হবে শুধু নারীরা। যে কারণে সমাজের নেতারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পরে তারা স্বপ্না রাণীকে একজন নারী চালক হিসেবে দেখেন এবং এখন সবাই তার অটোরিকশায় উঠেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, ‘মূলধারার সমাজ ব্যবস্থা নারীদের সুযোগ দিলে যে তারাও নিজেদের অবস্থান থেকে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অংশ নিতে পারে এটি তার উদাহরণ।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শহর এলাকার নারীদের চেয়ে গ্রামের নারীরা এখন অনেক বেশি প্রগতিশীল। আমাদের উচিত সম-অধিকার নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে আমাদের সহায়তা বাড়ানো উচিত; বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহায়তা, যাতে তারা নিজে থেকেই উদ্যোগ শুরু করতে পারে।’

ad

পাঠকের মতামত